দীর্ঘদিন ধরে আটকে থাকা কম্প্রিহেনসিভ ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড রেস্টোরেশন অব তিস্তা রিভার প্রজেক্ট (টিআরসিএমআরপি) বা তিস্তা নদীর সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা ও পুনরুদ্ধার প্রকল্পের প্রথম ধাপের কাজ শুরু করার লক্ষ্যে ঢাকা ও বেইজিংয়ের মধ্যে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে। এ উদ্যোগ বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশ ২০২৯ সালের মধ্যে তিস্তা নদী বরাবর একটি বিস্তীর্ণ এলাকা পুনরুদ্ধার ও পুনঃউন্নয়ন করতে পারবে।
প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ে ৭৪৭.২৫ মিলিয়ন হাজার ডলার ব্যয়ে ১৭০.৮৭ বর্গকিলোমিটার ভূমি পুনরুদ্ধার ও উন্নয়ন করা হবে। এর মধ্যে ৫৫০.৬২ মিলন ডলার চীনা ঋণ থেকে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে।
চলতি মাসে সংশোধিত প্রাথমিক উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (পিডিপিপি) চীনা দূতাবাসে জমা দেওয়া হয়েছে। এটি এখন চীন সরকারের কাছে পাঠানোর অপেক্ষায় আছে।
প্রায় এক দশক আগে ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড ও চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত পাওয়ার কনস্ট্রাকশন কর্পোরেশন অভ চায়না-র (পাওয়ার চায়না) মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই হয়েছিল। কিন্তু পরিবর্তিত ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থতির কারণে প্রকল্পটির আর অগ্রগতি হয়নি।
এখন অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে বাংলাদেশ ও চীন নতুন করে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে দুই দেশের মধ্যে নতুন করে ঋণ আলোচনা শুরু হয়েছে। যেহেতু প্রকল্পটি মূলত চীনা অর্থায়নে বাস্তবায়িত হচ্ছে, তাই ঋণ-সংক্রান্ত আলোচনা চলমান রয়েছে।
পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ চলতি বছরের ৩০ জুন প্রস্তাবটিতে শর্তসাপেক্ষে নীতিগত অনুমোদন দেন এবং প্রস্তাবের কয়েকটি উপাদানের ব্যয় যৌক্তিক নির্ধারণের কথা বলেন। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) ও পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, বিদেশি অর্থায়ন নিশ্চিত করতে প্রকল্পটি এরপর ইআরডিতে পাঠানো হয়েছে।
টিআরসিএমআরপির প্রথম পর্যায় বাস্তবায়নে সরকারের সিদ্ধান্ত জানিয়ে একটি চিঠিসহ প্রস্তাবটি ইতিমধ্যে গত ১৩ আগস্ট ঢাকাস্থ চীনা দূতাবাসে পাঠানো হয়েছে।
চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, তিস্তা অববাহিকায় নতুন অর্থনৈতিক কেন্দ্র স্থাপনের মাধ্যমে এই প্রকল্পটি পুরো রংপুর অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বড় ভূমিকা রাখবে।
এর আগে ২০২১ সালে জমা দেওয়া প্রাথমিক ঋণ আবেদন পর্যালোচনা করে ২০২৩ সালের মার্চে চীন সরকার বাংলাদেশকে একটি সংশোধিত প্রকল্প প্রস্তাব ও সম্ভাব্যতা সমীক্ষা প্রতিবেদন পাঠাতে বলেছিল।
পুনরুদ্ধার করা জমিকে নগর, শিল্প, কৃষি ও পুনর্বাসন—এই চারটি পৃথক এলাকায় ভাগ করা হবে নতুন এই পরিকল্পনা অনুযায়ী।
প্রস্তাব অনুসারে, ৬.৮২ বর্গকিলোমিটার ভূমিতে একটি আধুনিক নগর কমপ্লেক্স গড়ে তোলা হবে। এখানে থাকবে আবাসিক এলাকা, বাণিজ্যিক কেন্দ্র ও অন্যান্য নাগরিক সুযোগ-সুবিধা। ৭২.৯৩ বর্গকিলোমিটার ভূমি শিল্পকারখানার জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে, যার মধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রসারের জন্য একটি ফটোভোলটাইক সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্রও থাকবে। ৫৪.৬৭ বর্গকিলোমিটার ভূমি খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে উন্নত কৃষি পদ্ধতির জন্য রাখা হবে। আর ৩৬.৪৫ বর্গকিলোমিটার এলাকা নদীভাঙনে বাস্তুচ্যুত মানুষদের পুনর্বাসনের জন্য ব্যবহার করা হবে, যা এ অঞ্চলের অন্যতম প্রধান সামাজিক সমস্যা সমাধানে সহায়ক হবে।
কর্মকর্তারা বলছেন, নগরায়ন, শিল্পায়ন, কৃষি ও পুনর্বাসনের এই সমন্বয় উত্তরবঙ্গে, বিশেষ করে বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলে তিস্তা অববাহিকাকে একটি নতুন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রে পরিণত করবে।
প্রকল্প প্রস্তাবে বাংলাদেশের চতুর্থ বৃহত্তম আন্তঃসীমান্ত নদী ও ব্রহ্মপুত্রের অন্যতম উপনদী তিস্তার ভয়াবহ পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়েছে।
প্রস্তাবে বলা হয়েছে, তিস্তা একটি ‘বিচরণশীল ও বিনুনিযুক্ত’ নদী এবং আকস্মিক বন্যাপ্রবণ নদী। কাউনিয়া পয়েন্টে ৫০ বছরের পুনরাবৃত্ত সময়ের জন্য নকশাকৃত প্রবাহ হলো প্রতি সেকেন্ডে ১০ হাজার ৬৮০ ঘনমিটার এবং গড় বার্ষিক পলি নির্গমন ৪৯ মিলিয়ন টন।
প্রকল্প প্রস্তাবে সতর্ক করা হয়েছে, প্রয়োজনীয় সুরক্ষামূলক ব্যবস্থার অভাবে বন্যায় নদীর উভয় তীর ভয়াবহ ভাঙন ও নদীগর্ভ ক্ষয়ের ঝুঁকিতে রয়েছে। প্রতি বছর নদীর উভয় তীরে বিশাল সম্পত্তি, জমি ও বাড়িঘর নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়।
তহবিলের অভাবে বিদ্যমান বাঁধগুলো ঠিকমতো রক্ষণাবেক্ষণ করা যায় না, যার ফলে বর্ষাকালে ভাঙন দেখা দেয়। ফলে প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষ ঘরবাড়ি, কৃষিজমি, ফসল ও জীবিকা হারায়। বহু মানুষ চরম দুর্দশার মধ্যে জীবনযাপন করে।
প্রথম পর্যায়ে তিস্তা ব্যারাজের ভাটি থেকে ব্রহ্মপুত্রের মোহনা পর্যন্ত ১০২ কিলোমিটার অংশে এ প্রকল্পের কাজ করা হবে।
এই পর্যায়ে প্রকৌশলগত কাজের মধ্যে উভয় তীরের বিদ্যমান বাঁধের মোট ৭৯.৬ কিলোমিটার মেরামত এবং নতুন ১২৪.২ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ করা হবে।
নদীশাসন নিয়ন্ত্রণের জন্য ১৫টি বিদ্যমান গ্রোয়েন মেরামত করা হবে। এছাড়া উভয় তীরে অতিরিক্ত ৫০টি নতুন গ্রোয়েন তৈরি করা হবে। এছাড়াও প্রয়োজন অনুযায়ী নতুন নদীর তীর সংরক্ষণ এবং বাঁধের ঢাল শক্তিশালীকরণ কাজ করা হবে।
প্রস্তাবে বলা হয়েছে, এই কাজগুলো নদীতীরের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা, শিক্ষা ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান, অবকাঠামো, জমি, বসতবাড়ি, বাজার, অফিস ইত্যাদি সম্পদ রক্ষা করবে। এই উদ্যোগে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগও তৈরি হবে। এর মধ্যে অন্তত ৩০ শতাংশ অপ্রযুক্তিগত চাকরি দরিদ্র, নারী ও অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ব্যক্তিদের জন্য নিশ্চিত করা হবে।
এতে শিল্প সরবাহ শৃঙ্খল সম্প্রসারিত হবে, কৃষি উৎপাদন বাড়বে এবং ঢাকা, চট্টগ্রাম ও খুলনার মতো বড় শহরগুলোতে উচ্চমূল্যের ফসল বিক্রির পাশাপাশি রপ্তানির সুযোগও তৈরি হবে।
প্রদা/ডিও