চট্টগ্রামের আকাশ, নদী ও ভূগর্ভস্থ পানি—সবখানেই এখন দূষণের ছাপ। প্রতিদিন নগরবাসী শ্বাস নিচ্ছে দূষিত বাতাসে, পান করছে ভারী ধাতু ও রাসায়নিক মিশ্রিত পানি। গবেষণা বলছে, দূষণের কারণে চট্টগ্রামবাসীর গড় আয়ু কমেছে প্রায় ছয় বছর। শিশু ও বয়স্করা রয়েছেন অকালমৃত্যুর ঝুঁকিতে।
বায়ু ও পানিদূষণে চট্টগ্রাম এখন ঝুঁকিপূর্ণ নগরী
কর্ণফুলী নদী, টিউবওয়েল ও ভূগর্ভস্থ পানির নমুনা বিশ্লেষণে দেখা গেছে, চট্টগ্রামে ক্রোমিয়াম, ক্যাডমিয়াম, সীসা ও ম্যাঙ্গানিজের পরিমাণ অনুমোদিত সীমার অনেক ওপরে। ডাম্পিং স্টেশনগুলোর আশপাশের পানিতে শনাক্ত হয়েছে বিপজ্জনক মাত্রার নাইট্রেট ও অ্যামোনিয়া।
গবেষকরা বলছেন, অপরিকল্পিত নগরায়ন, শিল্পবর্জ্য ব্যবস্থাপনার ঘাটতি ও প্রশাসনিক অদক্ষতার কারণে চট্টগ্রাম এখন জনস্বাস্থ্যের জন্য উচ্চঝুঁকির অঞ্চলে পরিণত হয়েছে।
বর্জ্যে দমবন্ধ নগরী
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশ্বব্যাংকের পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, নগরের ৪১টি ওয়ার্ডে বছরে প্রায় ২ লাখ ৫৭ হাজার মেট্রিক টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপন্ন হয়। এর মধ্যে প্রায় ২৭ শতাংশ—অর্থাৎ ৭০ হাজার টনের বেশি—নালা, খাল ও নদীতে পড়ে মারাত্মক দূষণ সৃষ্টি করছে।
বন্দর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, কর্ণফুলী নদীর ২ থেকে ৭ মিটার গভীরতায় পলিথিন ও প্লাস্টিকের স্তর জমে রয়েছে, যা ড্রেজিং কার্যক্রমে বড় বাধা।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন প্রতিদিন গড়ে ৩ হাজার টন বর্জ্য উৎপাদনের তথ্য দিয়েছে, যার এক তৃতীয়াংশ অনিয়ন্ত্রিতভাবে ফেলা হয় খাল ও সড়কে, ফলে সৃষ্টি হচ্ছে জলাবদ্ধতা ও পরিবেশদূষণ।
বায়ুদূষণে গড় আয়ু কমেছে ছয় বছর
শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের এনার্জি পলিসি ইনস্টিটিউটের (ইপিআইসি) ‘এয়ার কোয়ালিটি লাইফ ইনডেক্স ২০২৫’-এ বলা হয়েছে, বাংলাদেশের বাতাসে সূক্ষ্ম ধূলিকণার (PM2.5) মাত্রা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত সীমার ১৫ গুণ।
এই দূষণের কারণে দেশের মানুষের গড় আয়ু কমছে পাঁচ বছর ছয় মাস, আর ঢাকা ও চট্টগ্রামে তা ছয় বছর পর্যন্ত। ১৯৯৮ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে সূক্ষ্ম ধূলিকণার ঘনত্ব বেড়েছে প্রায় ৬৬ শতাংশ।
ফিনল্যান্ডভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর রিসার্চ অন এনার্জি অ্যান্ড ক্লিন এয়ার-এর হিসেবে, কেবল বায়ুদূষণেই প্রতিবছর দেশে অকালমৃত্যু হচ্ছে এক লাখেরও বেশি মানুষের, যার প্রায় অর্ধেক ঢাকা ও চট্টগ্রামের বাসিন্দা।
ভূগর্ভস্থ পানিতে বিপদ সংকেত
চুয়েটের ২০২৩ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, চট্টগ্রাম নগরের ভূগর্ভস্থ পানিতে আয়রন, ম্যাঙ্গানিজ ও ক্যাডমিয়ামের মাত্রা অনুমোদিত সীমার চেয়ে অনেক বেশি। বিশেষ করে অগভীর কূপগুলোতে পরিস্থিতি ভয়াবহ।
গবেষকরা সতর্ক করেছেন—দীর্ঘদিন এই পানি পান করলে কিডনি, লিভার ও ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ে।
২০২৫ সালের জুলাইয়ে প্রকাশিত আরেক গবেষণায় ল্যান্ডফিল এলাকার ভূগর্ভস্থ পানিতে নাইট্রেট ও অ্যামোনিয়ার মাত্রা অতিরিক্ত পাওয়া গেছে। এর জন্য দায়ী ল্যান্ডফিল থেকে নিঃসৃত তরল বর্জ্য।
কর্ণফুলী নদী: দূষণ ও দখলে বিপর্যস্ত
চট্টগ্রামের প্রাণ কর্ণফুলী নদী প্রতিদিন পাচ্ছে প্রায় ৫ হাজার মেট্রিক টন বর্জ্য। গবেষণায় দেখা গেছে, নদীর পানিতে ৫ মিলিমিটারের কম আকারের মাইক্রোপ্লাস্টিক কণা মাছ ও অন্যান্য প্রাণীর দেহে প্রবেশ করছে—ফলে দূষণ ছড়িয়ে পড়ছে খাদ্যচক্রেও।
নদী দখলও মারাত্মক। ১৯৯০ সালে ব্রিজঘাট এলাকায় কর্ণফুলীর প্রস্থ ছিল ৯০০ মিটার, এখন তা কমে ৫১০ মিটারে দাঁড়িয়েছে। দুই তীরে গড়ে উঠেছে দুই হাজারের বেশি অবৈধ স্থাপনা।
কর্ণফুলী নদী প্রতিদিন প্রায় ২৮ কোটি লিটার পানীয় জলের উৎস হলেও এখন সেই পানির মান নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
কৃষিজমিতেও ভারী ধাতুর প্রভাব
সীতাকুণ্ডের শিপইয়ার্ড এলাকার কৃষিজমিতে সীসা, ক্রোমিয়াম, ক্যাডমিয়াম, তামা, জিঙ্ক ও নিকেলের মাত্রা অনুমোদিত সীমার চেয়ে অনেক বেশি পাওয়া গেছে।
ফলে মাটির মাইক্রোবায়াল জীববৈচিত্র্য কমে যাচ্ছে, কমে যাচ্ছে ফসল উৎপাদনের সক্ষমতাও। গবেষকরা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ ও দূষণ নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
প্রশাসনের ব্যাখ্যা
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের এক কর্মকর্তা বলেন, “আমরা প্রতিদিন ২,২০০ থেকে ২,৪০০ টন গৃহস্থালি বর্জ্য সংগ্রহ করছি। তবে শিল্পবর্জ্য নদীতে পড়ছে, যা আমাদের আওতার বাইরে। অনেক নাগরিকও বর্জ্য খাল ও ড্রেনে ফেলছেন, এতে মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণ বাড়ছে। শতভাগ বর্জ্য সংগ্রহ ও ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে কাজ চলছে।”
শিল্প ও বন্দরনগরী হিসেবে পরিচিত চট্টগ্রাম এখন জনস্বাস্থ্যের জন্য উচ্চঝুঁকির নগরীতে পরিণত হচ্ছে। গবেষকরা বলছেন, দূষণ রোধে প্রশাসন, শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও নাগরিকদের সমন্বিত উদ্যোগ না নিলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে উঠবে।
প্রদা/ডিও