চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) শিক্ষার্থী ও স্থানীয়দের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। শনিবার রাত থেকে গতকাল সারা দিন এ সংঘর্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মো. কামাল উদ্দিন ও প্রক্টর তানভীর মোহাম্মদ হায়দার আরিফসহ আহত হয়েছেন তিন শতাধিক শিক্ষার্থী ।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) শিক্ষার্থী ও স্থানীয়দের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। শনিবার রাত থেকে গতকাল সারা দিন এ সংঘর্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মো. কামাল উদ্দিন ও প্রক্টর তানভীর মোহাম্মদ হায়দার আরিফসহ তিন শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। চবি ক্যাম্পাস ও আশপাশ এলাকায় আজ রাত ১২টা পর্যন্ত ১৪৪ ধারা জারি করেছে প্রশাসন।
চবি ক্যাম্পাস সূত্রে জানা গেছে, শনিবার রাতে চবির ২ নম্বর গেট বাজার এলাকায় ভাড়া বাসার দারোয়ান এক ছাত্রীকে মারধর করেন। এ ঘটনায় ক্যাম্পাসসংলগ্ন জোবরা গ্রামের বাসিন্দাদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের এ সংঘর্ষের সূত্রপাত। এ সময় এলাকাটি রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি এতে বেশ কয়েকজন কর্মরত সাংবাদিকও আহত হয়েছেন। তবে কোনো গ্রামবাসী আহত হয়েছে কিনা এমন তথ্য পাওয়া যায়নি। আহতদের চবি মেডিকেলে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হয়। গুরুতর আহতদের চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে পাঠানো হয়। চিকিৎসক সংকট থাকায় রেড ক্রিসেন্টের সদস্যদের আহত শিক্ষার্থীদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিতে দেখা যায়।
এদিকে আজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ধরনের পরীক্ষা কার্যক্রম বন্ধ থাকবে বলে জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। তবে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি।
দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য কামাল উদ্দিন ও প্রক্টর তানভীর মোহাম্মদ হায়দার আরিফ আহত হলেও বিকাল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত প্রশাসন ও নিরাপত্তা বাহিনীর কোনো সদস্যকে ঘটনাস্থলে দেখা যায়নি। নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের উপস্থিতি না থাকায় থমথমে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় ক্যাম্পাসজুড়ে। অন্যদিকে একটু পরপর অটোরিকশা ও মোটরসাইকেলে আহত শিক্ষার্থীদের মেডিকেল সেন্টারে নেয়া হলে তাদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হয়। গুরুতর আহতদের অ্যাম্বুলেন্সে করে চমেকসহ অন্যান্য হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সরজমিনে দুপুরে ক্যাম্পাসের ২ নম্বর গেট এলাকায় গিয়ে এ দৃশ্য দেখা যায়।
এদিকে বিকাল সাড়ে ৪টায় সেনাবাহিনী, র্যাব ও পুলিশ সদস্যরা ঘটনাস্থলে এলে তারা শিক্ষার্থীদের বাধার মুখে পড়েন। তারা ‘ভুয়া-ভুয়া’ স্লোগান দিতে থাকেন। পরে ২ নম্বর গেট এলাকার বিভিন্ন মেস, কটেজ ও বাসায় অবরুদ্ধ শিক্ষার্থীদের উদ্ধার করা হয়। এ সময় কাউকে গ্রেফতার বা আটক করতে দেখা যায়নি।
এদিকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) মো. কামাল উদ্দিন এ হামলার ঘটনায় ছাত্রলীগের ক্যাডাররা জড়িত বলে মন্তব্য করেন। তিনি চবি মেডিকেল সেন্টারে আহত শিক্ষার্থীদের দেখতে এসে বলেন, ‘ছাত্রলীগের ক্যাডাররা হেলমেট পরে এ হামলায় অংশ নেয়। আমার প্রশাসনের অনেক কর্মকর্তা আহত হয়েছেন। এত আহত শিক্ষার্থী আসছে যে তাদের হাসপাতালে জায়গা দেয়া যাচ্ছে না। গুরুতর আহতদের চট্টগ্রাম মেডিকেলে পাঠানো হয়। আমরা সেনাবাহিনী, পুলিশ ও উপদেষ্টাদের সঙ্গে কথা বলার পরেও তারা শিক্ষার্থীদের সহায়তায় এগিয়ে আসেনি।’
চট্টগ্রাম মেডিকেল সেন্টারে আহত শিক্ষার্থীরা বলেন, রাতের পর সকালে আবারো সংঘর্ষ শুরু হয়। আমাদের বন্ধুরা আহত হচ্ছে শুনে আমরা ক্যাম্পাসের ২ নং গেট এলাকায় চলে আসি। পরে এলাকাবাসী দেশী অস্ত্র নিয়ে আমাদের ওপর হামলা চালায়। যেখানেই আমাদের ভাই-বন্ধুদের পেয়েছে, সেখানেই নির্মমভাবে পিটিয়ে বা কুপিয়ে রক্তাক্ত করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো কর্মকর্তা, শিক্ষক বা প্রশাসনের কোনো কর্মকর্তা সংঘর্ষের এলাকায় আসেনি। এমন অথর্ব প্রশাসন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে এসেছিল কিনা জানি না।’
এদিকে আহত শিক্ষার্থীদের মধ্যে অন্তত ২০০ জন চিকিৎসা নিয়েছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টারে। এছাড়া চমেক হাসপাতালে শতাধিক এবং হাটহাজারী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অন্তত ১০ জন ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন বলে জানান হাসপাতালের ডাক্তাররা। গুরুতর আহত ২০২০-২১ বর্ষের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষার্থী ইমতিয়াজ আহমেদ সায়েমকে বেসরকারি পার্কভিউ হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। চিকিৎসকরা জানান, এখন পর্যন্ত তাকে ছয়-সাত ব্যাগ রক্ত দেয়া হয়েছে। তিনি হাসপাতালটির আইসিইউতে চিকিৎসাধীন। সায়েমের হাতে ও গায়ে রামদা দিয়ে কোপানো হয়েছে। মাথার মাঝ বরাবর কোপ দেয়ায় তার অবস্থা আশঙ্কাজনক।
এদিকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই পক্ষের সংঘর্ষের ঘটনায় উসকানি দেয়ায় বিএনপির জাতীয় কমিটির সদস্য উদয় কুসুম বড়ুয়ার প্রাথমিক সদস্যপদসহ সব পর্যায়ের পদ থেকে বহিষ্কার করেছে বিএনপি। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ ঘোষণা দেয়া হয়। ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে দেখা যায় সংঘর্ষের ঘটনায় এলাকাবাসীর পক্ষ নিয়ে চবি শিক্ষার্থীদের কুলাঙ্গার বলে গালি দিতে এবং শিক্ষার্থীদের ছাড় না দেয়ার ঘোষণা দিতে দেখা যায় বিএনপির এ নেতাকে।
ঘটনাস্থলে থাকা শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, সকালেও সেনাবাহিনীর সদস্যরা ক্যাম্পাসে ছিলেন। কিন্তু প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাদের ক্যাম্পাস থেকে চলে যেতে বলা হয় এবং নিজেরা সমাধান করবে বলে সিদ্ধান্ত নেয় চবি প্রশাসন। কিন্তু দুপুরে উল্টো ঘটনা ঘটে। শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি শিক্ষকরাও নির্মমতার শিকার হন। এমন প্রশাসন দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় চলতে পারে না। এমনকি ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানের নায়ক রাফি ও রাসেলকেও কোনো শিক্ষার্থীর পাশে এসে কথা বলতে দেখা যায়নি।
শনিবার রাতে এক নারী শিক্ষার্থী মেসের বাসায় ঢুকতে গেলে দেরি করে বাসায় ফেরার কারণে দরজা বন্ধ করে রাখেন দারোয়ান। পরে বাসায় থাকা আরো কিছু ছাত্রী এসে দরজা খোলার জন্য বললে তাদের সঙ্গে দারোয়ানের বাগ্বিতণ্ডা শুরু হয়। একপর্যায়ে ওই ছাত্রীর গায়ে হাত তোলেন দারোয়ান। পরে বিষয়টি জানাজানি হলে শিক্ষার্থীরা দারোয়ানকে ধাওয়া দিলে স্থানীয়দের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষের সূত্রপাত ঘটে। রাতেই সেনাসদস্যরা ঘটনাস্থলে এলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। সকালে আবারো দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়ে দিনভর চলে।
অন্যদিকে বাকৃবি প্রশাসনিক ভবনে অবরুদ্ধ শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের উদ্ধারে শিক্ষার্থীদের ওপর অস্ত্রশস্ত্রসহ হামলার ঘটনা ঘটেছে। গতকাল রাত পৌনে ৮টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন মিলনায়তনের সামনে এ ঘটনা ঘটে। এতে সাংবাদিক ও শিক্ষার্থীসহ কমপক্ষে ১০ জন আহত হয়েছেন।
উদ্ভূত পরিস্থিতির কারণে বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। গতকাল রাত সাড়ে ৯টার দিকে অনলাইনে জরুরি সিন্ডিকেট সভায় এ সিদ্ধান্ত নেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের আজ সকাল ৯টার মধ্যে হল ত্যাগের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের উদ্ধারে বহিরাগতরা এ হামলা চালিয়েছে। তাৎক্ষণিক আহত শিক্ষার্থীদের নাম-পরিচয় পাওয়া যায়নি। তাদের হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
জানা যায়, কম্বাইন্ড ডিগ্রির দাবিতে পশুপালন ও ভেটেরিনারি অনুষদের শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করছিলেন। আন্দোলন চলাকালে সন্ধ্যা ৭টা ৪০ মিনিটের দিকে একদল দুর্বৃত্ত লাঠিসোটা হাতে নিরস্ত্র শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায়। হামলাকারীরা মিলনায়তনের তালা খুলে ভেতরে ৮ ঘণ্টা আটকে থাকা শিক্ষকদের বের করে আনে।
আন্দোলনকারীরা জানান, শিক্ষার্থীদের ন্যায্য দাবির আন্দোলন দমাতে সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও কিছু শিক্ষকের প্রত্যক্ষ ইন্ধনে বহিরাগতদের ক্যাম্পাসে আনা হয়। তারা সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায়। নারী শিক্ষার্থীরাও হামলার শিকার হন।
এ ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় রাত ৯টায় দিকে বিভিন্ন হল থেকে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল বের করে। বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অফিস ও উপাচার্যের বাসভবনে ভাংচুর চালায়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘অন্যান্য অনুষদের শিক্ষার্থীরা আমাদের তালা ভেঙে বের করেছে। বহিরাগতরা শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করেছে কিনা সেটি আমরা জানি না। শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নেয়ার পরও তারা আমাদের আটক করে রাখল। আমরা শিক্ষক সমিতির সদস্যরা জরুরি মিটিং করেছি। সেখানে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, এ আটক করে রাখার ঘটনার সুষ্ঠু বিচার না হওয়া পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষা কার্যক্রমে আমরা অংশগ্রহণ করব না।’
গতকাল কম্বাইন্ড ডিগ্রি বাস্তবায়নে আয়োজিত একাডেমিক কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত ফলপ্রসূ না হওয়ায় সভায় উপস্থিত উপাচার্যসহ ২২৭ জন শিক্ষককে অবরুদ্ধ করে তালা ঝুলিয়ে দেয় বাকৃবির পশুপালন ও ভেটেরিনারি অনুষদের শিক্ষার্থীরা।
প্রদা/ডিও