প্রথমে যেটিকে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানিকারকদের জন্য বড় ধাক্কা বলে মনে করা হয়েছিল, সেটিই অপ্রত্যাশিতভাবে এক বড় সুযোগে পরিণত হয়েছে। পোশাকের অনেক ক্রেতা প্রতিষ্ঠান বা বায়ার, আগে যারা চীন ও ভারত থেকে পোশাক কিনত—-তারা এখন বাংলাদেশের সঙ্গে অর্ডার নিয়ে প্রাথমিক পর্যায়ে আলোচনা শুরু করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানিতে ৩৫ শতাংশ পাল্টা শুল্ক (রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ) আরোপ করেন—যা তখনও পর্যন্ত ভারত ও পাকিস্তানের প্রস্তাবিত হারের চেয়ে অনেক বেশি ছিল—তখন রপ্তানিকারকরা প্রধান রপ্তানির এখাতে বড় আঘাতের আশঙ্কা করেছিলেন।
তবে নাটকীয়ভাবে, ১ আগস্ট শুল্কারোপের সময়সীমার কয়েক ঘণ্টা আগে—যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের ওপর শুল্ক কমিয়ে ২০ শতাংশ করে, এবং ভারতের ক্ষেত্রে তা ২৫ শতাংশ করে বাড়ায়। এছাড়া রাশিয়ার তেল কেনার কারণে ২৭ আগস্ট থেকে ভারতের ওপর অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ শুল্কারোপের ঘোষণা দেয়।
ভারত, চীন ও মিয়ানমার থেকে আগে যেসব ক্রেতা অর্ডার করত, তারা এখন বাংলাদেশে কার্যাদেশ দিতে প্রাথমিকভাবে যোগাযোগ করছে। স্থানীয় পোশাক প্রস্তুতকারকরা এই সুযোগটি কাজে লাগাতে—আগে স্থগিত রাখা কারখানা সম্প্রসারণের পরিকল্পনা পুনর্জীবিত করছেন, বন্ধ থাকা কারখানা খুলছেন, নতুন বিনিয়োগের কথাও ভাবছেন।
কেবল দেশীয় প্রতিষ্ঠানই নয়, এর প্রভাব পড়ছে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের ক্ষেত্রেও। বৈশ্বিক সোর্সিং প্রবণতা বদলাতে দেখে চীনা বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশকে নতুন উৎপাদনকেন্দ্র হিসেবে সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করছেন। ট্রাম্পের শুল্ক, যা একসময় হুমকি মনে হয়েছিল—সেটিই এখন দেশের অন্যতম বড় বাণিজ্যিক সুযোগে পরিণত হয়েছে।
শুধু পোশাক খাত নয়, ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্পের উদ্যোক্তারাও নতুন বিনিয়োগের পরিকল্পনা করছেন।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল গত ১০ আগস্ট ঢাকার এক অনুষ্ঠানে বলেন, “এখন বিনিয়োগের সেরা সময়।” উদ্যোক্তাদের জন্য সরকারি সহায়তা চেয়ে তিনি জানান, “আমরা আবার বিনিয়োগে প্রস্তুত।”
২০২২ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে বিটিএমএ’র উদ্যোক্তারা বস্ত্র খাতে ৩ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ পরিকল্পনা ঘোষণা করেছিলেন। তবে গ্যাস সংকটসহ নানা কারণে কিছু বিনিয়োগকারী সরে যান। প্রকৃত বিনিয়োগের পরিমাণও প্রকাশ করা হয়নি।
মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির তথ্যে তাদের সতর্ক অবস্থানের চিত্র ফুটে ওঠে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০২৩–২৪ ও ২০২৪–২৫ অর্থবছরে ক্যাপিটাল মেশিনারি আমদানি কমেছে, সর্বশেষ অর্থবছরে তা আগের বছরের তুলনায় ২৫.৪১ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান বায়ার ওয়ালমার্ট, গ্যাপ ইনকসহ ইউরোপীয় ব্র্যান্ড বার্সকার সঙ্গে বাংলাদেশে অর্ডার বাড়ানোর পরিকল্পনা জানতে যোগাযোগ করে টিবিএস। তবে এই প্রকাশের সময় পর্যন্ত তাদের থেকে কোনো সাড়া মেলেনি।
বাংলাদেশে চীনা বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ
যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক পরিবর্তনে সৃষ্ট সুযোগ কাজে লাগাচ্ছেন চীনা বিনিয়োগকারীরা। তারা নতুন বিনিয়োগ, কারখানা ভাড়া নেওয়া এবং বিদ্যমান অবকাঠামো ব্যবহার করে বাংলাদেশে উৎপাদন শুরু করতে আগ্রহী দেখাচ্ছেন।
এক নিটওয়্যার কারখানার মালিক নাম না প্রকাশের শর্তে জানান, “আমি ইতোমধ্যে একটি কারখানা চীনা উদ্যোক্তাদের কাছে ভাড়া দিয়েছি। গত সপ্তাহে তারা আরেকটি কারখানা রেন্ট নেওয়ার আগ্রহ দেখিয়েছে।”
শিল্পসংশ্লিষ্টরা জানান, চীনা বিনিয়োগকারীরা নতুন বিনিয়োগের পাশাপাশি চলমান নয়—এমন রেডি-টু-ইউজ কিন্তু বর্তমানে বন্ধ আছে এমন কারখানা কিনতেও আগ্রহী।
এছাড়া চীনা বায়িং হাউসগুলো বাংলাদেশের পোশাক কারখানার সঙ্গে ফ্রি অব চার্জ (এফওসি) ব্যবসায়িক মডেল কাজ করার সুযোগ খুঁজছে। এধরনের ব্যবস্থায়—বায়াররা কাঁচামাল সরবরাহ ও আর্থিক খরচ বহন করে, আর কারখানা কর্তৃপক্ষ শুধু উৎপাদনের দায়িত্ব নেয়। এতে প্রস্তুতকারকের ঝুঁকি কম হলেও লাভের হারও কম, কারণ শুধু কাটিং ও মেকিং খরচ দেওয়া হয়।
বন্ধ কারখানা পুনরুজ্জীবিত হওয়ার সম্ভাবনা
বিজিএমইএর তথ্য অনুযায়ী, গত দুই বছরে ১৯১টি কারখানা বন্ধ হয়েছে, যার বেশিরভাগই ছোট। একই সময়ে প্রায় ১০০টি নতুন কারখানা উৎপাদন শুরু করেছে। বন্ধ হওয়া কারখানার মধ্যে বড় কারখানায় ১৫ হাজার পর্যন্ত শ্রমিক ছিল।
বিজিএমইএ নেতারা মনে করছেন, বাজার পরিস্থিতি উন্নত হলে – বড় ও ছোট উভয় ধরনের বন্ধ কারখানাই পুনরায় চালু হতে পারে।
ইউরোপে বাড়তি প্রতিযোগিতা নিয়ে শঙ্কা
এই আশাবাদের মাঝেও কেউ কেউ সতর্ক রয়েছেন। তাদের আশঙ্কা, প্রতিযোগী যেসব দেশ যুক্তরাষ্ট্রের বাজার হারাবে, তারা ইউরোপের বাজার হিস্যার জন্য তীব্র প্রতিযোগিতা শুরু করবে। এতে দাম কমে যাবে এবং বাংলাদেশের রপ্তানিকাররা চাপের মুখে পড়বেন।
বর্তমানে বাংলাদেশের রপ্তানির অর্ধেকের বেশি যায় ইউরোপে, আর যুক্তরাষ্ট্রে যায় ২০ শতাংশেরও কম।