রমজানেও স্বাভাবিক হয়নি গ্যাসের সংকট। রমজান মাসে বিদ্যুৎ উৎপাদনে যে গ্যাসের চাহিদা রয়েছে তা বৃদ্ধিতে পরিস্থিতি আরও অবনতি হয়েছে। এতে সরবরাহের ঘাটতি বেড়েছে শিল্পসহ অন্যান্য উৎপাদনমুখী খাতে। বিশেষ করে বিদ্যুৎ উৎপাদনে দেখা দিয়েছে উভয় সংকট। কারণ গ্যাসের বিকল্প জ্বালানিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় হয় দ্বিগুণের চেয়েও বেশি। অন্য দিকে বিদ্যুতে গ্যাসের সরবরাহ বাড়ালে সমস্যায় পড়বে শিল্পখাত।
এমনিতেই দেশে চাহিদার তুলনায় ৪০-৫০ শতাংশ গ্যাসের সংকট রয়েছে। তাই রেশন ব্যবস্থা অবলম্বন করে সরবরাহ করা হচ্ছে। সরবরাহকৃত গ্যাসের বড় অংশই ব্যবহৃত হয় থাকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে। তা সত্ত্বেও পর্যাপ্ত পরিমাণে গ্যাস সরবরাহ করতে পারছে না জ্বালানি বিভাগ। চাহিদা বৃদ্ধির সাথে সাথে গ্যাসের সরবরাহ বাড়ছে না। বর্তমানে এই খাতে গ্যাসের ঘাটতি ছাড়িয়েছে ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট। অন্য দিকে আগের মতোই সরবরাহ ঘাটতি অব্যাহত রয়েছে শিল্পে।
বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে গ্যাসের ব্যবহার বৃদ্ধি ঘটলে শিল্পখাতে বিদ্যমান গ্যাস সংকট আরও বাড়িয়ে দিতে পারে। অন্য দিকে অন্যান্য জ্বালানিতেও বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়ালে গ্রাহকের ব্যয় আরও বাড়িয়ে দিবে।
কারণ, ফেব্রুয়ারি থেকে প্রতিমাসেই জ্বালানি ও বিদ্যুতের ভতুর্কির পরিমাণ কমে গ্রাহকদের জন্য যে দাম সমন্বয় করা হয়েছে। সে হিসেবে এপ্রিলের দিকে বিদ্যুতের দাম আরও এক ধাপ বাড়বে। এ অবস্থায় বর্ধিত বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে এবং দাম সহনীয় রাখতে গ্যাসকেই প্রাধান্য দেওয়া যেতে পারে।
বর্তমানে দেশে বিদ্যুতের চাহিদা রয়েছে প্রায় ১৩ হাজার মেগাওয়াট। যা এপ্রিলের মধ্যে ১৫ হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়ে যেতে পারে। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) তথ্যনুয়ায়ী, বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রায় ৬০ শতাংশই হচ্ছে গ্যাসভিত্তিক।
তবে চাহিদা আরও বাড়লে তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো উৎপাদন বাড়ানো হতে পারে।
একদিকে জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় করা হলেও, অন্যদিকে ডিজেলের দাম লিটারে মাত্র ৭৫ পয়সা কমেছে। ফলে তেল চালিত বিদ্যুতে গ্রাহকের ব্যয় বাড়িয়ে দিতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। এর বিকল্প হিসেবে গ্যাস আমদানি করা সুযোগ থাকলেও পরিবহণ ও অবকাঠামোগত সক্ষমতার কারণে তা দিয়ে বিদ্যুতের ক্ষেত্রে গ্যাসের সরবরাহের বৃদ্ধি সুযোগ কম বা নেই বললেই চলে।
দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষমতার ১১ হাজার মেগাওয়াটের বেশিই গ্যাসভিত্তিক। বিপিডিবির কর্মকর্তাদের মতে, বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রায় ১৩শ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের চাহিদা থাকলেও সরবরাহ রয়েছে ৯০০ মিলিয়ন ঘনফুটের মতো। ফলে ঘাটতি মেটাতে তেলভিত্তিক কেন্দ্রগুলো চালু করতে হচ্ছে।
অন্যদিকে দেশের শিল্পখাতের উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, বর্তমানে শিল্পখাতে গ্যাস সরবরাহের দিকে প্রাধান্য দিলেও চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস পাচ্ছে না ঢাকা, চট্টগ্রাম , নারায়ণগঞ্জসহ গাজীপুর ও সাভার অঞ্চলের কারখানাগুলো। অথচ দীর্ঘদিন ধরেই স্থানীয় গ্যাসের উৎপাদন নিম্নমুখী। আমদানির মাধ্যমে এই ঘাটতি মেটানো হলেও এখন তা সম্ভব হচ্ছে না। মূলত আমদানি গ্যাস পরিবহণ ও মজুদের বিদ্যমান অবকাঠামোগত সক্ষমতার চেয়ে ঘাটতি বেড়ে যাওয়া পরিস্থিতি জটিল হয়েছে। এই অবস্থায় একমাত্র নিজস্ব গ্যাসের উত্তোলন বৃদ্ধি ছাড়া গ্যাসের সরবরাহ নিশ্চিত সম্ভব নয় বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস্ ম্যানুফাকচার্স অ্যান্ড এক্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি ও শিল্প উদ্যোক্তা শহীদুল্লাহ আজিম জানান, গ্যাস সরবরাহ পরিস্থিতি গত দুই বছর ধরেই খারাপ। এখন যা স্থায়ী রূপ নিয়েছে। অগ্রাধিকার দেওয়ার পরেও ৪০-৪৫ শতাংশ গ্যাসের সরবরাহ মিলছে। ফলে উৎপাদন ব্যয় ২ থেকে আড়াই গুণ পর্যন্ত বেড়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ তিন শিফটের পরিবর্তে মাত্র এক শিফট ফ্যাক্টরি চালাচ্ছে। এমন অবস্থা চলতে থাকলে শিল্পসহ সামগ্রিক রপ্তানিখাতগুলো দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আর্থিক লোকসানের পাশাপাশি রপ্তানি বাজার হারানোর শঙ্কাও রয়েছে।
দৈনিক অর্থনীতি