পৃথিবীর ইতিহাসে দেখা যায়, মানুষকে হত্যা করা হয় দু’ভাবে। প্রত্যক্ষ আর পরোক্ষভাবে। প্রত্যক্ষ বলতে সরাসরি আঘাত করে হত্যা করা। আর পরোক্ষ বলতে কোনো মানুষের শরীরে বিষ প্রয়োগ করে ধীরে ধীরে তাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া। আমাদের দেশে দুই ধরনের অপরাধই প্রতিনিয়ত হচ্ছে। প্রত্যক্ষ অপরাধের জন্য মৃদ্যুদন্ডের বিধান যেমনি, তেমনি পরোক্ষ অপরাধের জন্যও রয়েছে বিধান। কিন্তু আমরা অধিকাংশ মানুষ পরোক্ষ সেই অপরাধের শাস্তির বিষয়ে জ্ঞাত নই। জ্ঞাত নই পরোক্ষ অপরাধ সম্পর্কেও। সেই পরোক্ষ অপরাধের মধ্যে খাদ্যে ভেজাল দেওয়া একটি বড় অপরাধ। এটা কোনোক্রমেই বিষপ্রয়োগের চেয়ে কম শাস্তিযোগ্য অপরাধ নয়। অথচ আমাদের সমাজে এটা এখন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। আমরা কেউ নিশ্চিত হয়ে বলতে পারব না, প্রতিদিন আমরা যা খাচ্ছি তা কতটা নিরাপদ। কারণ ভেজাল খাদ্যে বাজার পরিপূর্ণ। নিজের কষ্টের টাকায় আমরা মহা-আনন্দে নিজের ও পরিবারের জন্য বিষ কিনে নিয়ে যাচ্ছি। বাস্তবতা হলো, আমাদের বিষ কিনে নিয়ে যেতে বাধ্য করা হচ্ছে। কারণ কোনটা যে ভেজালমুক্ত খাদ্য, তা নির্ণয় করাও কঠিন সবার জন্য। তাই জেনে বা না জেনে বিষ খেতে বাধ্য হচ্ছে মানুষ। আইন থাকলেও প্রয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের দূর্বলতার কারণে নিরুপায় জনগণ জিম্মি বিষ প্রয়োগকারীদের কাছে। তারই মধ্যে আসছে রমজান মাস। এই মাসকে কেন্দ্র করে ভেজালকারীরা আরো ব্যস্ত হয়ে পড়বেন খাদ্যে ভেজাল দেওয়ার প্রতিযোগিতায়।
দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হলেও নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে বেগ পেতে হচ্ছে সরকারকে। বিশেষজ্ঞদের মতে, উৎপাদন থেকে শুরু করে বাজারজাতকরণ পর্যন্ত ভেজাল পণ্যের ছড়াছড়ি। টেক্সটাইলের কাপড়ের রং ও ফ্লেভার মিশিয়ে তৈরি করা হচ্ছে জুস, আইসক্রিম, মিষ্টি, পাউরুটি, বিস্কুট, ললিপপ, চকোলেট এবং কেক এমনকি শিশু খাদ্য গুঁড়ো দুধেও পাওয়া যাচ্ছে ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদান। মূলত এসব পণ্যের সহজলভ্যতা ও প্রশাসনের সঠিক নজরদারির অভাব এর জন্য দায়ী। এসব খাবার খেয়ে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। ডায়াবেটিকস ছাড়াও লিভার ও কিডনি বিকল, হার্ট অ্যাটাক, ক্যান্সারসহ নানা ধরনের রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ৪৫ লাখ মানুষ খাদ্যের বিষক্রিয়ায় এসব বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।
অভিযোগ রয়েছে, দেশে খাদ্যে ভেজালকারীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়ার কোনো নজির নাই। অথচ অবাক করা বিষয় হলো, আমাদের দেশে ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ২৫ (গ)-এর ১ (ঙ) ধারায় খাদ্যে এবং ওষুধে ভেজাল মেশালে বা বিক্রি করলে অপরাধী ব্যক্তির মৃত্যুদন্ড বা যাবজ্জীবন বা ১৪ বছর কারাদন্ডের বিধান রয়েছে। আইনের খাতায় এমন শাস্তির বিধান থাকলেও আমরা কখনো শুনিনি খাদ্যে ভেজাল দেওয়ার অপরাধে কারো মৃত্যুদন্ড বা যাবজ্জীবন হয়েছে। আমরা মাঝে মাঝে যা দেখি তা হলো মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে ভেজালকারীকে আর্থিক দণ্ড দেওয়া হয়। তবে জরিমানার অঙ্কটা এতটাই কম হয় যে, অপরাধী তাৎক্ষণিক সেই টাকা পরিশোধ করে কিছুদিন বিরতি দিয়ে আবারও মহা-আনন্দে বলা যায় প্রায় দ্বিগুণ উৎসাহে ভেজাল খাদ্য বিক্রির মহোৎসবে মেতে উঠেন। এছাড়া খাদ্যে ভেজাল বন্ধে প্রশাসন মাঝে মধ্যে ঝটিকা অভিযান চালায়। নিয়মিত অভিযান না চালানোর কারণে খাদ্যে ভেজাল দেয়ার সাথে জড়িত চক্রটি আবারও মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। বর্তমান সময়ে বিশেষ করে দুই যুগ ধরে এ দেশে খাদ্যে ভেজাল মেশানোর মাত্রা আশঙ্কাজনকহারে বেড়ে গেছে। দিন দিন তা হয়ে উঠছে সবার জন্য অসহনীয়।
অন্যদিকে জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. আনিছুর রহমান বলেন, ”ভেজাল খাদ্যপণ্য তৈরিতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে আমরা নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছি। এছাড়া সরকারের অন্যান্য সংস্থাও অভিযান পরিচালনা করে আসছে। অভিযানে অনিয়ম দেখলে আমরা জরিমানা করছি। একই সাথে দ্বিতীয়বার যাতে এই ধরণের অনিয়ম না করে সেজন্য সতর্কও করছি।
তবে এক্ষেত্রে ভোক্তাদেরও সচেতন হওয়া দরকার। কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব শ্রেণিকক্ষে বাংলাদেশের (ক্যাব) চট্টগ্রাম বিভাগীয় সভাপতি এস এম নাজের হোসেন বলেন, ”ভেজাল খাদ্যপণ্য তৈরি কারখানাতে প্রশাসন অভিযান চালিয়ে জরিমানা করে দায় সারে। এক্ষেত্রে যদি জরিমানার পরিবর্তে যদি অপরাধীদের জেল দেয়া যায়, তাহলে অপরাধের প্রবণতা কমতো। আবার দেখা যায়, প্রশাসন জরিমানা দেয়ার পরে তিন মাস আর ওই প্রতিষ্ঠানের আশপাশেও যায় না। ফলে ওই অপরাধী একই ধরণের কাজ করতে আরো বেপরোয়া হয়ে উঠে। তাই যাদেরকে একবার জরিমানা করা হচ্ছে তাদের কড়া নজরদারিতে রাখা দরকার।