ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে ও উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় রোববার বলেছেন, তার দল আওয়ামী লীগের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা না হলে সমর্থকরা ফেব্রুয়ারির জাতীয় নির্বাচন প্রতিহত করবে। তিনি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, প্রতিবাদ সহিংস রূপ নিতে পারে।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সসের কাছে জয় এই মন্তব্য এমন এক সময়ে করেছেন, যখন তার এক দিন পর [আজ সোমবার (১৭ নভেম্বর)] ঢাকার একটি আদালতে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে মামলার রায় ঘোষণা করবেন বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি)। এ রায় সরাসরি টেলিভিশনে সম্প্রচার করা হবে। একইসঙ্গে রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন স্থানে বড় পর্দায় রায় দেখানোর কথা রয়েছে।
ধারণা করা হচ্ছে, ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার ও দমন-পীড়নের অভিযোগে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ৭৮ বছর বয়সী হাসিনাকে তার অনুপস্থিতিতেই দোষী সাব্যস্ত করা হবে। হাসিনা অবশ্য সব অভিযোগ অস্বীকার করে মামলাটিকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে দাবি করেছেন।
জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছরের ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত সরকারবিরোধী বিক্ষোভের সময় নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে সর্বোচ্চ ১,৪০০ জন নিহত এবং হাজারো মানুষ আহত হয়। এটিকে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর বাংলাদেশের সবচেয়ে ভয়াবহ রাজনৈতিক সহিংসতা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
‘হাসিনাকে সম্ভবত মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে’
২০২৪ সালের আগস্টে বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর থেকে হাসিনা নয়াদিল্লিতে নির্বাসনে রয়েছেন। জয় বলেন, ভারত তাকে পূর্ণ নিরাপত্তা দিচ্ছে এবং ‘রাষ্ট্রপ্রধানের মতো’ আচরণ করছে।
ওয়াশিংটন ডিসিতে বসবাসকারী জয় বলেন, ‘আমরা জানি রায় কী হতে চলেছে। তারা এটি টেলিভিশনে সম্প্রচার করছে। তারা তাকে দোষী সাব্যস্ত করবে এবং সম্ভবত মৃত্যুদণ্ড দেবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমার মায়ের তারা কী করতে পারবে? আমার মা ভারতে নিরাপদে আছেন। ভারত তাকে পূর্ণ নিরাপত্তা দিচ্ছে।’
হাসিনার টানা ১৫ বছরের শাসনের অবসানের পর দায়িত্ব নেওয়া নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের একজন মুখপাত্র এই বিচার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত—এমন অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, আদালত ‘স্বচ্ছভাবে কাজ করেছে, পর্যবেক্ষকদের সুযোগ দিয়েছে এবং নিয়মিত নথি প্রকাশ করেছে’।
অক্টোবরে রয়টার্সকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে হাসিনা বলেছিলেন, নিরাপত্তার কারণে সতর্ক থাকলেও তিনি দিল্লিতে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারেন।
তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের রায় একটি ‘পূর্বনির্ধারিত উপসংহার’, কারণ ‘এই বিচার প্রক্রিয়াটি ছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এক প্রহসন’।
জয় বলেন, আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণে একটি গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় না আসা পর্যন্ত তারা আপিল করবেন না। জাতীয় নিরাপত্তার হুমকি এবং দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধে তদন্তের কথা উল্লেখ করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দলটির রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করার পর মে মাসে আওয়ামী লীগের নিবন্ধন স্থগিত করা হয়।
তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ ছাড়া কোনো নির্বাচন হতে দেওয়া হবে না। আমাদের প্রতিবাদ আরও জোরালো হবে এবং আমরা যা করা দরকার তাই করব। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যদি কিছু না করে, তাহলে এই নির্বাচনের আগে বাংলাদেশে সম্ভবত সহিংসতা হবে… সংঘাত হবে।’
সরকারের মুখপাত্র জানিয়েছেন, আওয়ামী লীগের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার কোনো পরিকল্পনা নেই। তিনি বলেন, ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সহিংসতার যেকোনো ধরনের উসকানিকে—বিশেষ করে নির্বাসিত রাজনৈতিক ব্যক্তিদের কাছ থেকে—অত্যন্ত দায়িত্বজ্ঞানহীন এবং নিন্দনীয় বলে মনে করে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বর্তমানে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আলোচনার কোনো সুযোগ নেই, কারণ দলটি তাদের শাসনামলে সংঘটিত মানবতারবিরোধী অপরাধের জন্য কোনো অনুশোচনা দেখানো এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালসহ জবাবদিহিতার প্রক্রিয়া মেনে নিতে ক্রমাগত অস্বীকৃতি জানিয়েছে।’
ঢাকায় একাধিক ককটেল বিস্ফোরণ
রায়ের আগে ঢাকায় রাজনৈতিক সহিংসতা বেড়েছে। রোববার রাজধানীতে বেশ কয়েকটি ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। শুধু ১২ নভেম্বরেই ৩২টি বিস্ফোরণের খবর পাওয়া গেছে; সঙ্গে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে কয়েক ডজন বাস। নাশকতার অভিযোগে পুলিশ আওয়ামী লীগ কর্মীদের আটক করেছে।
নিরাপত্তা জোরদারে কর্তৃপক্ষ অতিরিক্ত ব্যবস্থা নিয়েছে। ৪০০-র বেশি বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে, চেকপয়েন্টগুলো আরও শক্তিশালী করা হয়েছে এবং জনসমাবেশ সীমিত করা হয়েছে।
সরকারের মুখপাত্র বলেছেন, ‘সরকারের অগ্রাধিকার হলো উত্তেজনা কমানো এবং জীবন ও সম্পত্তির সুরক্ষা।’
জয় জানান, তিনি ও হাসিনা বাংলাদেশে দলীয় কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন; তবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বা প্রতিদ্বন্দ্বী বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) সঙ্গে নয়।
তিনি বলেন, ‘আপনারা গত কয়েকদিন ধরে দেশজুড়ে হরতাল, সারাদেশে ব্যাপক বিক্ষোভ দেখছেন, এবং এগুলো কেবল আরও বাড়বে।’
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে রূপান্তর আনার কৃতিত্ব হাসিনাকে দেওয়া হলেও, তার বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং ভিন্নমত দমনের অভিযোগ রয়েছে। ২০২৪ সালে প্রধান বিরোধী দলের বয়কট করা নির্বাচনে তিনি টানা চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় আসেন। সে সময় বিরোধী দলের বহু নেতাকে কারাগারে পাঠানো হয় বা তারা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান।
এখন পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। জয় বলেন, ‘তিনি (হাসিনা) বিপর্যস্ত, ক্রুদ্ধ, ক্ষুব্ধ। এবং আমরা যেকোনো উপায়ে পাল্টা লড়াই করতে বদ্ধপরিকর।’
প্রদা/ডিও





