আইনবিধির তোয়াক্কা না করে একের পর এক বহুতল ভবন গড়ে উঠেছে চট্টগ্রামে। নকশা অনুমোদনের পরের ধাপগুলো মানা হয়নি, গুণগত মানহীন উপকরণ ব্যবহার করা হয়েছে। তাই বড় মাত্রার ভূমিকম্প হলে চট্টগ্রাম নগরের অন্তত ৭০ শতাংশ ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলে আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নকশা না মেনে ভবন করা, গুণগত মানসম্পন্ন নির্মাণ উপকরণসামগ্রী ব্যবহার না করায় বেশি ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। ভূমিকম্প হলে উদ্ধার তৎপরতা চালানো ও পরিস্থিতি মোকাবিলায় সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর যথাযথ প্রস্তুতি ও সুযোগ-সুবিধাও নেই।
গতকাল শুক্রবার সকাল ১০টা ৩৮ মিনিটে ভয়াবহ ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থান। বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এই ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৫ দশমিক ৭। এর উৎপত্তিস্থল চট্টগ্রাম থেকে প্রায় আড়াই শ কিলোমিটার দূরের নরসিংদীর মাধবদী। এ ঘটনার পর দিনভর চট্টগ্রামে ভবনের নিরাপত্তাঝুঁকি নিয়ে আলোচনা ছিল। অনেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এ বিষয় নিয়ে সরব ছিলেন।
ভূমিকম্পে নগরের মনসুরাবাদ এলাকার ‘স্টার ভবন’ নামের একটি ছয়তলা ভবন হেলে পড়েছে বলে জানিয়েছেন এলাকাবাসী। গতকাল বেলা সাড়ে তিনটার দিকে ওই ভবন পরিদর্শন করেছেন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স এবং ডবলমুরিং থানার পুলিশ সদস্যরা।
দেখা যায়, ভবনের ছাদ পাশের আরেক ভবনের দিকে কিছুটা হেলে পড়েছে। পাশের ভবনের মালিক আবদুল্লাহ বিন আশরাফ জানান , প্রায় পাঁচ বছর আগে ভবনটি কিছুটা হেলে পড়েছিল। গতকাল ভূমিকম্পের পর আরও হেলেছে। যেকোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। চট্টগ্রাম নগরে ইমারত বিধিমালা না মেনে অনেক ভবন নির্মাণ করা হয়েছে, এ কথা সত্য। ফলে ৭ থেকে ৮ মাত্রার ভূমিকম্পে নগরের ৭০ শতাংশ ভবন সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অর্থাৎ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে ২ লাখ ৬৭ হাজার ভবন।
ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, গতকালের ভূমিকম্পে চট্টগ্রামে কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। অবশ্য সাম্প্রতিক সময়ে ভূমিকম্পে চট্টগ্রামে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতির ঘটনা ঘটেনি। তবে ২০১৬ সালের ১৩ এপ্রিল সন্ধ্যা ৭টা ৫৫ মিনিটে ৬ দশমিক ৯৯ মাত্রার ভূমিকম্পে নগরে ১২টি ভবন হেলে পড়েছিল। এর আগে ১৯৯৭ সালের ২১ নভেম্বর ৬ দশমিক ১ মাত্রার ভূমিকম্পে চট্টগ্রাম নগরে পাঁচতলা ভবন ধসে হতাহতের ঘটনা ঘটেছিল।
ঝুঁকিতে আড়াই লাখের বেশি ভবন
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে চট্টগ্রাম নগরে ৩ লাখ ৮২ হাজার ১১১টি ভবন রয়েছে। এর মধ্যে একতলা ভবন রয়েছে ২ লাখ ৭৮ হাজার ৫টি। ২ থেকে ৫ তলাবিশিষ্ট ভবন রয়েছে ৯০ হাজার ৪৪৪টি। ৬ থেকে ১০ তলা পর্যন্ত ভবনের সংখ্যা ১৩ হাজার ১৩৫। ১০ তলার ওপরে ভবন রয়েছে ৫২৭টি। নগরে এখন ২০ তলার বেশি ভবন রয়েছে ১০টি। এই বিপুলসংখ্যক ভবন নির্মাণ করা হলেও এগুলোর অধিকাংশই ইমারত বিধিমালা মানেনি বলে অভিযোগ রয়েছে।
বিধিমালা না মানার বিষয়টি উল্লেখ করে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস জানান, চট্টগ্রাম নগরে ইমারত বিধিমালা না মেনে অনেক ভবন নির্মাণ করা হয়েছে, এ কথা সত্য। ফলে ৭ থেকে ৮ মাত্রার ভূমিকম্পে নগরের ৭০ শতাংশ ভবন সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অর্থাৎ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে ২ লাখ ৬৭ হাজার ভবন।
২০২২ সালে ভূমিকম্পের ঝুঁকি নিয়ে একটি গবেষণা করেন ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির জ্যেষ্ঠ প্রভাষক আজমির ইবনে ইসলাম ও গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সেলিম শাদমান। তাঁরা চট্টগ্রাম শহরকে গবেষণার কার্যক্রম পরিচালনার এলাকা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। গবেষণা প্রবন্ধে বলা হয়, দ্রুত নগরায়ণ, অপরিকল্পিত বৃদ্ধি এবং সঠিক পরিকল্পনার অভাবের কারণে চট্টগ্রাম শহর ভূমিকম্পের মতো দুর্যোগের জন্য অত্যন্ত অরক্ষিত হয়ে উঠেছে।
ওই জরিপের তথ্য অনুযায়ী, সে সময় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এলাকায় ভবন ছিল ১ লাখ ৮২ হাজার (মূলত একতলার ঊর্ধ্বে ভবনগুলোকে জরিপের আওতায় আনা হয়েছিল)। এর মধ্যে ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রাখা হয় ১ লাখ ৬৮ হাজার ১৫০টি ভবন, যা মোট ভবনের ৯২ শতাংশ। বাংলাদেশ জাতীয় বিল্ডিং কোড অনুযায়ী ভবনগুলো নির্মাণ করা হয়নি। জরিপ অনুযায়ী, সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে হাসপাতাল, ক্লিনিক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
ভবন নির্মাণে যে নিয়ম
চট্টগ্রাম মহানগর ইমারত (নির্মাণ, উন্নয়ন, সংরক্ষণ ও অপসারণ) বিধিমালা, ২০০৮ অনুযায়ী, ভবন নির্মাণের সময় আটটি স্তরে অনুমোদন নিতে হয় উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের। এগুলো হলো ভূমি ব্যবহার ছাড়পত্র, নির্মাণ অনুমোদন, নির্মাণকাজ শুরু অবহিতকরণ ও কারিগরি ব্যক্তিদের সম্মতিপত্র, ভবনের ভিত্তি স্তম্ভ পর্যন্ত কাজ সম্পর্কে কারিগরি ব্যক্তিদের প্রতিবেদন, ভবনের নির্মাণকাজ সমাপ্তি অবহিতকরণপত্র, কারিগরি ব্যক্তিদের প্রত্যয়নপত্র, ব্যবহার সনদ ও পাঁচ বছর পর ব্যবহার সনদ নবায়ন। চট্টগ্রামে গড়ে ওঠা অধিকাংশ ভবনের নকশা অনুমোদন নেওয়া হয়েছে ঠিকই, তবে অনুমোদনের পরের ধাপগুলো অনুসরণ করা হয়নি।
সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস এই ঘাটতির কথা স্বীকার করেছেন। গতকাল চট্টলা২৪কে তিনি বলেন, বর্তমানে অনুমোদন পাওয়া ভবনগুলোর ক্ষেত্রে নিয়মিত তদারক করা হচ্ছে।
দুর্যোগ মোকাবিলায় ঘাটতি
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চট্টগ্রামের বেশির ভাগ ভবনে ভূমিকম্প-প্রতিরোধী কোনো ব্যবস্থা নেই। সিডিএও কোনো ধরনের তদারক করেনি। বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে এগুলোর বেশির ভাগ পুরোপুরি ধসে পড়বে, কিছু আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এতে প্রচুর মানুষ হতাহত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
এ ধরনের বিপর্যয় পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য সরকারি সংস্থাগুলোর প্রস্তুতিতে ঘাটতি রয়েছে বলে মনে করেন নগরের বাসিন্দা ও বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলছেন, ফায়ার সার্ভিস, সিটি করপোরেশন, সিডিএ—কারও ভূমিকম্প নিয়ে প্রস্তুতি নেই। উদ্ধার তৎপরতার জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতিও নেই। আবার অনেক ভবন নির্মাণ করা হয়েছে ঘিঞ্জি এলাকায়। কোথাও কোথাও গলিগুলো এমন সরু, সেখানে উদ্ধারকারী গাড়ি, অ্যাম্বুলেন্স যাওয়ার সুযোগ পর্যন্ত নেই।
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) সাবেক উপাচার্য মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম জানান চট্টগ্রাম ভূমিকম্পের জন্য ঝুঁকিতে রয়েছে। কেননা ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে বেশির ভাগই আইন ও বিধি মানেনি। সিডিও তদারক করেনি। এ ছাড়া দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রস্তুতির ঘাটতি রয়েছে।
প্রদা/ডিও







