একশ বছরের মধ্যে দেশে উৎপত্তি হওয়া সবচেয়ে বড় ভূমিকম্প দেখলো দেশবাসী, যা ‘ভয়াবহ’ ভূকম্পনের পূর্বাভাস বলে মনে করছে বিশেষজ্ঞরা। এখনই প্রস্তুতি না নিলে ঘটতে পারে মহামারি। বিশেষ করে রাজধানীতে ক্ষয়ক্ষতি হতে পরে অবর্ণনীয়।
রিখটার স্কেলে ৫ দশমিক ৭ মাত্রায় যে ভূমিকম্পটি নরসিংদীর মাধবদীতে হলো, তা মাঝারি মানের বলছেন আবহাওয়াবিদরা। এতেই রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে প্রাণ গেল ১০ জনের। মাটিতেও ফাটল ধরেছে। রাজধানীতে ভবন ধসে পড়া বা হেলে পড়া, ফাটল ধরার মতো ঘটনা ঘটেছে। ভূমিকম্পনের কারণ জানা গেলেও এটি রুখে দেওয়ার মতো কোনো পদ্ধতি বা প্রযুক্তি আজও আবিষ্কৃত না হওয়ায় সচেতনতা অবলম্বনকেই গুরুত্ব দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
ভূমিকম্পের কারণ
পৃথিবীর উপরিভাগ কয়েকটি অনমনীয় টেকটোনিক প্লেটে বিভক্ত। ভূগর্ভের বিভিন্ন পদার্থের কারণে প্লেটগুলোর ওপর চাপ সৃষ্টি হলে এগুলো একে অপরের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। এতে শক্তিশালী তরঙ্গ (ওয়েভ) তৈরি হয়, যার তীব্রতাই ভূমিকম্পের মাত্রা নির্ধারণ করে। এই তরঙ্গ যখন পৃথিবীর পৃষ্ঠে পৌঁছে ঝাঁকুনি সৃষ্টি করে—সেটাই ভূমিকম্প।
শুক্রবার (২১ নভেম্বর) সকাল ১০টা ৩৮ মিনিটে মাধবদীতে অনুভূত ভূমিকম্পও টেকটোনিক প্লেটের সংঘর্ষ থেকেই উৎপন্ন হয়েছিল।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সম্প্রতি হওয়া ছোট ও মাঝারি ভূমিকম্প সামনে বড় মাত্রার ভূমিকম্পের ইঙ্গিত দিচ্ছে। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে তেমন ঝুঁকিতেই রয়েছে বাংলাদেশ। বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে ঢাকা শহর। কারণ এ শহরের বেশির ভাগ ভবন বিল্ডিং কোড মেনে নির্মিত হয়নি। এছাড়া এমন প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতি কমাতে তেমন ব্যবস্থা নেয়নি কোনো সরকার।
বড় ভূমিকম্প আবারও ঘুরে আসতে পারে
আবহাওয়াবিদ একেএম নাজমুল হক জানান, সিলেট এলাকায় সম্ভবত ১৮৯৭ সালের দিকে একটি বড় ভূমিকম্প হয়েছিল। ভূমিকম্প সাধারণত নির্দিষ্ট সময় পরপর পুনরাবৃত্তি ঘটে—যাকে বলা হয় পিরিয়ডিক্যাল কম্পন। সাধারণত ১০০ বছর পর বড় ভূমিকম্প ফিরে আসে বলেও ধারণা করা হয়।
ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল
আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, রংপুর, ময়মনসিংহ, সিলেট, ঢাকা, কুমিল্লা ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের কিছু অংশ উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে।
ঢাকার একটি অংশ, মানিকগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, কুমিল্লা, চাঁদপুর, ফেনী, নোয়াখালী, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, নওগাঁ, রাজশাহী, নাটোর, চাঁপাইনবাবগঞ্জের কিছু অংশ মাঝারি ঝুঁকিতে রয়েছে৷
অন্যদিকে খুলনা ও বরিশাল বিভাগকে কম ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়েছে।
বড় ভূমিকম্পের দ্বারপ্রান্তে বাংলাদেশ?
ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের সহকারী আবহাওয়াবিদ ফারজানা সুলতানা বলেন, বড় ভূমিকম্পের আগে ছোট ভূকম্পন হতে পারে—আবার বড় ভূমিকম্পের পরেও আফটারশক হয়। এসব কখন হবে তার নির্দিষ্ট সময় জানা সম্ভব নয়।
মাধবদীর সাম্প্রতিক কম্পনটিকে তিনি মাঝারি ধরনের বলে উল্লেখ করেন। তার মতে, ১৯১৮ সালের পর এটিই দেশের ভেতরে সবচেয়ে বড় ভূমিকম্প। সে সময় শ্রীমঙ্গলের কম্পনের মাত্রা ছিল ৭.৬। ভূমিকম্প চক্র অনুযায়ী বাংলাদেশ এখন বড় ভূমিকম্পের সময়কালীন ‘দ্বারপ্রান্তে’ অবস্থান করছে বলেও তিনি সতর্ক করেন।
বুয়েটের অধ্যাপক ও ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ মেহেদী আহমেদ আনসারী জানান—
-
৭ মাত্রার ভূমিকম্প ১০০–১২৫ বছর পরপর
-
আর ৮ মাত্রার ভূমিকম্প ২৫০–৩০০ বছর পরপর ঘটে থাকে
ব্যতিক্রম জাপান, প্রয়োজন উদ্যোগ
পৃথিবীর সবচেয়ে ভূকম্পন বেশি যে দেশগুলোতে হয় তার মধ্যে অন্যতম জাপান। তাই জাতিগতভাবে তারা এটি অন্যদের চেয়ে ক্ষতি বেশি কমাতে সক্ষমতা অর্জন করেছে। সে ব্যবস্থা অন্যরাও অনুকরণ করতে পারে।
ফারজানা সুলতানা বলেন, ভূকম্পনের প্রি ওয়েব রিসিভ করা যায়। ওটা সেটা করে সঙ্গে সঙ্গে গ্যাস, বিদ্যুতের মতো পরিসেবাগুলো বন্ধ করে দেয়। এ ছাড়া ব্লিডিং কোড মেনে ওরা ভবন তৈরি করে৷ ফলে বড় ভূমিকম্প হলেও ক্ষতি কম হয়। তাই সহনশীল করে ভবন তৈরি করা খুব গুরুত্বপূর্ণ।
বিশেষজ্ঞরা জানান, বাংলাদেশে সিলেট থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত পার্বত্য এলাকায় শক্তিশালী ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সেই সঙ্গে ভারতের মণিপুর, মিজোরাম ও মিয়ানমারের পার্বত্য এলাকাও ঝুঁকির মধ্যে আছে।
১৯৯৭ সালে চট্টগ্রামে ৬ দশমিক ১ মাত্রার ভূমিকম্পে ২৩ জনের মৃত্যু হয়। তবে ক্ষয়ক্ষতি খুব বেশি হয়নি। দুই বছর পর ১৯৯৯ সালে মহেশখালীতে একটি ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৫ দশমিক ২। সেবার অন্তত ছয়জনের মৃত্যু হয়।
প্রদা/ডিও







