ভারতের বৃহত্তম শিল্পপ্রতিষ্ঠান রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ রাশিয়ার অপরিশোধিত তেল কেনা আংশিক বন্ধ করেছে। গুজরাট প্রদেশের জামনগরে তাদের যে রপ্তানিমুখী তেল পরিশোধনাগার আছে, তার জন্য রাশিয়ার অপরিশোধিত তেল কেনা হবে না।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিষেধাজ্ঞা মেনে এ তেল কেনা বন্ধ করেছে রিলায়েন্স। নিষেধাজ্ঞায় বলা হয়েছিল, তৃতীয় দেশ হয়ে রাশিয়ার অপরিশোধিত তেল কেনা যাবে না। এ নিষেধাজ্ঞা ভঙ্গ করা হলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ নিষেধাজ্ঞা আগামী বছর, অর্থাৎ ২০২৬ সাল থেকে কার্যকর হওয়ার কথা। কিন্তু রিলায়েন্স তার আগেই রাশিয়ার তেল কেনা বন্ধ করল। খবর বিবিসি
ভারত রাশিয়া থেকে যে অপরিশোধিত তেল কেনে, তার একটি অংশ পরিশোধন করে আবার রপ্তানি করে। আরেক অংশ দেশেই ব্যবহৃত হয়।
একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার অন্যতম বৃহৎ তেল রপ্তানিকারী প্রতিষ্ঠান রজনেফট ও লুকঅয়েলের ওপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। গতকাল শুক্রবার থেকে এ নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হয়েছে। সেই নিষেধাজ্ঞা মানতেও রিলায়েন্স রাশিয়ার তেল কেনা বন্ধ করেছে।
বিবৃতিতে রিলায়েন্স বলেছে, ২০২৬ সালের ২১ জানুয়ারি নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হওয়ার আগেই তার প্রতি মান্যতা দেখিয়ে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। হোয়াইট হাউস রিলায়েন্সের এ সিদ্ধান্ত স্বাগত জানিয়েছে।
হোয়াইট হাউসের প্রেস অফিস বলেছে, এ পরিবর্তন তারা স্বাগত জানায়। সেই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র-ভারত বাণিজ্য আলোচনা অর্থবহভাবে এগিয়ে নিতে আগ্রহী তারা। এর আগে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একাধিকবার বলেছেন, ভারত রাশিয়া থেকে তেল বন্ধ করবে। ভারত তার জবাবে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু না বললেও কার্যত দেখা যাচ্ছে, রাশিয়ার তেল কেনা তারা কমিয়ে দিয়েছে।
মূল কারণ হলো মে মাস থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের ভারতের রপ্তানি কমেছে ৩৭ দশমিক ৫ শতাংশ। সেপ্টেম্বর মাসে ৫০ শতাংশ শুল্ক কার্যকর হওয়ার পর সে মাসে পণ্য রপ্তানি কমেছে ২০ শতাংশ।
বিবাদের কারণ রাশিয়ার তেল
ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে এখন বাণিজ্য বিবাদ চলছে, তার অন্যতম কারণ রাশিয়ার তেল। যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞা অগ্রাহ্য করে ভারত রাশিয়ার তেল কিনে গেছে। শুধু তা–ই নয়, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর রাশিয়া থেকে ভারতের তেল কেনা কয়েক গুণ বেড়েছে। যুদ্ধ শুরুর আগে ২০২২ সালে ভারতের মোট তেল আমদানির মাত্র ২ দশমিক ৫ শতাংশ আসত রাশিয়া থেকে। ২০২৪-২৫ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ৩৫ দশমিক ৮ শতাংশে। রিলায়েন্স ভারতের সবচেয়ে বড় রুশ তেল আমদানিকারক। ভারত যে পরিমাণ রাশিয়ার তেল কেনে, তার অর্ধেক বা ৫০ শতাংশই আসে রিলায়েন্সের মাধ্যমে।
২০২২ সালে রাশিয়া আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার মুখে তেল বিক্রিতে অনেকটা ছাড় দিলে ভারত তার সুযোগ নেয়। ফলে তারা ডলার–সংকট ও উচ্চ মূল্যস্ফীতির কবলে পড়েনি।
সেই ২০২২ সাল থেকেই মস্কো থেকে তেল কেনা কমাতে ভারতের ওপর চাপ আছে। কিন্তু দিল্লি দিনের পর দিন সেই চাপ অগ্রাহ্য করে গেছে। কিন্তু ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক চাপ এখন ভারতের ওপর প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে বলে মনে হচ্ছে। গত এক-দুই মাসে ভারতীয় তেল শোধনাগারগুলো রাশিয়ার তেল আমদানি কমিয়ে দিয়েছে—বিভিন্ন প্রতিবেদনে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
যুক্তরাষ্ট্র-ভারত বাণিজ্য আলোচনা ভালোই এগোচ্ছিল। সেই সঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির যে রসায়ন, তাতে ধারণা করা হয়েছিল, দুই দেশের বাণিজ্যচুক্তি ভালোভাবেই হয়ে যাবে। কিন্তু কৃষিসহ দেশি স্বার্থ রক্ষায় ভারত ছাড় দিতে একেবারেই অনড় ছিল। সেই সঙ্গে অব্যাহত ছিল রাশিয়ার তেল কেনা।
এ পরিস্থিতির সমাধান না হলে আগস্ট মাসে ট্রাম্প ভারতের পণ্যে ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেন। কেন ৫০ শতাংশ, তার ব্যাখ্যাও দেন ট্রাম্প। এর মধ্যে ২৫ শতাংশ নিছক বাণিজ্যিক শুল্ক, বাকি ২৫ শতাংশ জরিমানা ছিল রুশ তেল কেনার শাস্তি। ট্রাম্প দাবি করেন, ভারত রাশিয়ার তেল কিনে ইউক্রেন যুদ্ধে অর্থায়ন করছে। এ অভিযোগ ভারত বরাবরই অস্বীকার করেছে।
কতটা কমেছে
কার্নেগি এনডাওমেন্টের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকা রুশ কোম্পানিগুলো থেকে রিলায়েন্সের তেল কেনা কমেছে ১৩ শতাংশ। একই সময় অক্টোবর মাসে সৌদি আরব থেকে ৮৭ শতাংশ ও ইরাক থেকে ৩১ শতাংশ আমদানি বেড়েছে।
ব্লুমবার্গের তথ্য অনুযায়ী, ভারতীয় রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত পরিশোধনাগারগুলো ডিসেম্বর মাসের জন্য রুশ অপরিশোধিত তেল আমদানি বন্ধ করছে বা কমাচ্ছে।
গ্লোবাল ট্রেড অ্যান্ড রিসার্চ ইনিশিয়েটিভের (জিটিআরআই) বিশেষজ্ঞ অজয় শ্রীবাস্তব বিবিসিকে বলেন, রাশিয়া থেকে তেল আমদানি ভারত অনেকটাই কমিয়ে দিয়েছে। ফলে ওয়াশিংটনকে অবশ্যই ভারতীয় পণ্যে ‘শাস্তিমূলক ২৫ শতাংশ’ শুল্ক অবিলম্বে বাতিল করতে হবে।
শ্রীবাস্তব আরও বলেন, ভারত যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাশা পূরণ করা সত্ত্বেও শুল্ক থাকলে বোঝা যাবে, যুক্তরাষ্ট্রের সদিচ্ছার অভাব আছে। দুই দেশের বাণিজ্য আলোচনা এমনিতেই নাজুক অবস্থায় আছে। এ শাস্তিমূলক শাস্তিমূলক শুল্ক থাকলে তা আরও নাজুক পরিস্থিতির মধ্যে পড়বে।
যুক্তরাষ্ট্রের ভারতের পণ্যে ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপের দুই দেশের মধ্যকার উত্তেজনা অনেকটাই বেড়েছিল। এর জেরে ভূরাজনৈতিক পরিবর্তনের আভাসও পাওয়া গেছে। কিন্তু কয়েক মাসের অনিশ্চয়তার পর উত্তেজনা ধীরে ধীরে কমছে বলে মনে হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্র থেকে এলএনজি আমদানি
এদিকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে জ্বালানি আমদানি বাড়িয়ে বাণিজ্যঘাটতি কমানোর চেষ্টা করছে ভারত। যেসব কারণে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যচুক্তি এখনো হয়ে ওঠেনি, তার মধ্যে প্রধান হলো দুই দেশের মধ্যকার ক্রমবর্ধমান বাণিজ্যঘাটতি। রাশিয়া থেকে জ্বালানি আমদানি হ্রাস করার বিষয়টি তো ছিলই।
গত সোমবার ভারতের পেট্রোলিয়াম ও প্রাকৃতিক গ্যাসবিষয়ক মন্ত্রী হারদ্বীপ সিং পুরি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের নতুন চুক্তির কথা জানিয়েছেন। এ চুক্তি অনুসারে, ভারত যে পরিমাণ তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস বা এলএনজি আমদানি করে, তার প্রায় ১০ শতাংশ করবে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। এ বাস্তবতায় ভারতের সরকারি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যচুক্তির প্রথম ধাপ শিগগিরই সই হওয়ার সম্ভাবনা আছে। খবর সিএনবিসি ও ইকোনমিক টাইমস।
প্রদা/ডিও







