মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ২৫ কোটি ডলারের নতুন হোয়াইট হাউস বলরুমের নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে। কিন্তু এর বিশাল খরচের যোগান কারা দিচ্ছে, সেই ধনী দাতা ও কর্পোরেশনগুলোর পরিচয় নিয়ে তৈরি হয়েছে রহস্য।
সোমবার ৯০,০০০ বর্গফুটের এই জমকালো প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। নির্মাণ শ্রমিকরা ইস্ট উইং-এর কিছু অংশ ভাঙার মাধ্যমে এই কাজ আরম্ভ করেন।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প জানিয়েছেন, তিনি ব্যক্তিগতভাবে নির্মাণের একটি বড় অংশের খরচ দেবেন। তিনি আরও বলেন, কিছু বেনামী দাতা এই প্রকল্পটি সম্পূর্ণ করার জন্য ২ কোটি ডলারের বেশি অনুদান দিতে ইচ্ছুক।
অর্থায়নের এই পদ্ধতি নিয়ে আইন বিশেষজ্ঞরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তাদের মতে, এটি আসলে প্রশাসনের আনুকূল্য পাওয়ার জন্য অর্থ প্রদানের সামিল হতে পারে।
২০০৫ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত বুশ হোয়াইট হাউসের প্রাক্তন প্রধান নীতি আইনজীবি রিচার্ড পেইন্টার বিবিসিকে বলেছেন, “আমি এই বিশাল বলরুমটিকে একটি নৈতিক দুঃস্বপ্ন হিসেবে দেখছি।”
তিনি আরও যোগ করেন, “হোয়াইট হাউসে প্রবেশের সুযোগ ব্যবহার করে টাকা তোলা হচ্ছে, যা আমার একদম পছন্দ নয়। এই কর্পোরেশনগুলো সবাই সরকারের কাছ থেকে কোনো না কোনো সুবিধা চায়।”
গত ১৫ অক্টোবর হোয়াইট হাউসে সম্ভাব্য দাতাদের জন্য একটি নৈশভোজের আয়োজন করা হয়। সেখানে আমেরিকার বিখ্যাত সংস্থাগুলির শীর্ষ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন, যেমন ব্ল্যাকস্টোন, ওপেনএআই, মাইক্রোসফট, কয়েনবেস, প্যালানটির, লকহিড মার্টিন, অ্যামাজন এবং গুগল। এছাড়াও নিউইয়র্ক জেটস এনএফএল দলের মালিক উডি জনসন এবং টাম্পা বে বুকানিয়ার্স ও ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের যৌথ মালিকানাধীন গ্লেজার ভাইবোনেরা উপস্থিত ছিলেন।
বিবিসি-র মার্কিন সহযোগী সিবিএস নিউজের হাতে আসা একটি অঙ্গীকারপত্র থেকে জানা যায়, দাতারা তাদের অবদানের জন্য ‘স্বীকৃতি’ পেতে পারেন। পরিকল্পনাটি চূড়ান্ত না হলেও, এই স্বীকৃতি হিসেবে বলরুমের দেয়ালে তাদের নাম খোদাই করা হতে পারে।
হোয়াইট হাউস প্রথমে জানিয়েছিল যে এই বিশাল কাঠামোতে ৬৫০ জন বসতে পারবে। কিন্তু এই সপ্তাহে ট্রাম্প বলেছেন, এর ধারণক্ষমতা হবে ৯৯৯ জন।
এখন পর্যন্ত মাত্র একজন অর্থদাতার পরিচয় প্রকাশ করা হয়েছে। আদালতের নথি অনুযায়ী, ইউটিউব এই প্রকল্পের জন্য ২.২ কোটি ডলার দেবে। ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি ক্যাপিটল হিলের দাঙ্গার পর ট্রাম্পের অ্যাকাউন্ট স্থগিত করা নিয়ে একটি মামলা হয়েছিল। সেই মামলার নিষ্পত্তির অংশ হিসেবেই ইউটিউব এই অর্থ প্রদান করছে।
তবে নৈশভোজে উপস্থিত বাকিদের মধ্যে কতজন অনুদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন বা কে কত টাকা দেবেন, তা এখনও স্পষ্ট নয়। হোয়াইট হাউসের কর্মকর্তারা একটি আনুষ্ঠানিক তালিকা প্রকাশের পরিকল্পনা করছেন বলে জানালেও, তা এখনও করা হয়নি।
সিবিএস-এর পাওয়া নথি থেকে জানা যায়, অনুদানগুলো ‘ট্রাস্ট ফর দ্য ন্যাশনাল মল’ নামক একটি অলাভজনক সংস্থা পরিচালনা করবে, যা হোয়াইট হাউস এবং ন্যাশনাল পার্কের বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য তহবিল সংগ্রহ করে।
সম্ভাব্য দাতাদের জন্য আয়োজিত সেই অনুষ্ঠানে ট্রাম্প বলেন, উপস্থিত অনেকেই ‘সত্যিই খুব উদার’ ছিলেন। তিনি জানান, কেউ কেউ জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে ২.৫ কোটি ডলার অনুদান দেওয়াটা ঠিক হবে কিনা। ট্রাম্প মন্তব্য করেন, “আমি বলেছিলাম: আমি এটা নেব।”
হোয়াইট হাউস জোর দিয়ে বলেছে যে অনুদান চাওয়ার মধ্যে আপত্তিকর কিছু নেই এবং এই বলরুমটি ভবিষ্যৎ প্রশাসনও ব্যবহার করবে। তারা আরও বলেছে, এই সংস্কারের জন্য মার্কিন করদাতাদের একটি পয়সাও খরচ হবে না।
সাতটি প্রশাসনের অধীনে কাজ করা হোয়াইট হাউসের প্রাক্তন নির্বাহী শেফ মার্টিন মঙ্গিলো বিবিসিকে বলেছেন, বলরুমের জন্য প্রদত্ত অর্থ “শেষ পর্যন্ত নিজের খরচ নিজেই তুলে নেবে “। তিনি বলেন, অনুষ্ঠানের জন্য বাইরে যে তাবুগুলো মাঝে মাঝে খাটানো হয়, সেখানে “একে অপরের সাথে গা ঘেঁষাঘেঁষি অবস্থা” তৈরি হয়, যা খুবই “বিব্রতকর”। বড় আকারের অনুষ্ঠান আয়োজনের অন্যান্য খরচ বাদেই শুধু এই তাবুগুলোর জন্যই প্রায়ই ১০ লক্ষ ডলার বা তার বেশি খরচ হয়ে যায়।
তবে, পেইন্টারের মতে, এটিকে একটি “পে-টু-প্লে স্কিম” (সুবিধা আদায়ের জন্য অর্থ প্রদানের খেলা) হিসেবে দেখা যেতে পারে, যা অতীতে উভয় রাজনৈতিক দলের প্রশাসনকেই সমস্যায় ফেলেছে। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৯০-এর দশকে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন নির্বাচনী প্রচারণার অনুদানের বিনিময়ে লিঙ্কন বেডরুমে রাত কাটানোর সুযোগ বিক্রি করার অভিযোগে তদন্তের মুখে পড়েছিলেন।
সম্প্রতি, ট্রাম্প এপ্রিলে বার্ষিক হোয়াইট হাউস ইস্টার এগ রোল অনুষ্ঠানের জন্য কর্পোরেট স্পনসর চেয়েছিলেন। সমালোচকদের মতে, এটি ছিল রাষ্ট্রপতির মনোযোগ আকর্ষণের জন্য সংস্থাগুলোর একটি প্রতিযোগিতা।
ট্রাম্প এবং প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলেছেন, রাষ্ট্রীয় নৈশভোজ এবং অন্যান্য বড় অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য উপযুক্ত জায়গার অভাব থাকায় নতুন বলরুমটি তৈরি করা জরুরি ছিল। হোয়াইট হাউসকে প্রায়শই বিদেশী নেতাদের আপ্যায়ন করতে এবং বড় অনুষ্ঠানের জন্য সাউথ লনে একটি তাবু ব্যবহার করতে হয়।
কিন্তু মিস্টার পেইন্টার যোগ করেছেন, নতুন বলরুমের বিশাল আকার রাজনৈতিক তহবিল সংগ্রহের জন্য একটি ‘প্রচণ্ড প্রলোভন’ তৈরি করবে, যা আগে সম্ভব ছিল না, যদিও উভয় দলের রাষ্ট্রপতিরাই সমর্থকদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, এখন জায়গার সীমাবদ্ধতার কারণে সবাই হোয়াইট হাউসের আমন্ত্রণ পায় না। আমার মতে, এটা একটা ভালো দিক… বর্তমান আকার অন্তত হোয়াইট হাউসের ভেতরে ‘সুবিধা আদায়ের খেলা’কে সীমিত রাখে।”
তবে, এক্ষেত্রে কোনো অন্যায় প্রমাণ করা প্রায় অসম্ভব। মিস্টার পেইন্টার বলেন, “আপনি এখানে ‘কুইড প্রো কো’ (একটির বিনিময়ে অন্যটি দেওয়া) প্রমাণ করতে পারবেন না। কিন্তু আমার মনে হয়, ট্রাম্প প্রশাসন এক্ষেত্রে সীমা লঙ্ঘন করছে।”
প্রদা/ডিও