চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের (সিপিএ) সাম্প্রতিক মাশুল বৃদ্ধিকে প্রথমে মনে হতে পারে দীর্ঘদিনের বিলম্বিত সমন্বয়। কারণ, ১৯৮৬ সালের পর থেকে বন্দরের ডলারভিত্তিক চার্জ কখনও বাড়ানো হয়নি। কিন্তু যা প্রকাশ্যে বলা হয়নি—সেটি হলো, টাকার মান কমে যাওয়ায় এতদিনেও বন্দরের টাকায় আয় বহুগুণে বেড়ে গেছে।
১৯৮৬ সালে এক ডলার ছিল ২৭ টাকা, এখন তা প্রায় ১২২ টাকা। ফলে ট্যারিফ না বাড়িয়েই বন্দরের আয় স্থানীয় মুদ্রায় চার গুণের বেশি বেড়েছে।
২০২৪-২৫ অর্থবছরে চট্টগ্রাম বন্দর রেকর্ড ২,৯১৩ কোটি টাকার মুনাফা করেছে। তাই প্রশ্ন উঠেছে—অর্থনীতি যখন টালমাটাল, ব্যবসায়ীরা যখন খরচের চাপে, তখন কেন এই বাড়তি মাশুল?
বে টার্মিনাল প্রকল্প ও আইএফসির ভূমিকা
বিশ্বব্যাংকের নির্বাহী বোর্ড ২০২৪ সালের জুনে বে টার্মিনাল প্রকল্পে ৬৫০ মিলিয়ন ডলারের ঋণ অনুমোদন দেয়। ২০২৫ সালের এপ্রিলেই বাংলাদেশ সরকার ও বিশ্বব্যাংকের মধ্যে চুক্তি সই হয়।
ঋণ অনুমোদনের সময় বিশ্বব্যাংক জানায়, তাদের বেসরকারি খাতের শাখা আইএফসি প্রস্তাবিত বেসরকারি টার্মিনালগুলোর একটিতে বিনিয়োগ বিবেচনা করছে।
এই বিষয়টিই এখন সম্ভাব্য স্বার্থসংঘাতের প্রশ্ন তুলছে। কারণ, আইএফসি একদিকে সরকারকে পরামর্শ দিয়েছে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে বন্দর মাশুল বাড়াতে, অন্যদিকে একই প্রকল্পে নিজেই বিনিয়োগের চিন্তা করছে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, এতে তাদের পরামর্শের নিরপেক্ষতা ও ন্যায্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে। বিশেষ করে যদি ধারণা জন্মায়, টেন্ডারের কাঠামো কোনো নির্দিষ্ট বিনিয়োগকারীর পক্ষে সাজানো হয়েছে।
‘সাকসেস ফি’ কাঠামো নিয়ে প্রশ্ন
আইএফসির পরামর্শ ফি মডেলে রয়েছে ‘সাকসেস ফি’ বা সফলতা ফি—যা সাধারণত মোট প্রকল্প মূল্যের একটি অংশ। প্রকল্প চুক্তি সম্পন্ন হলেই এ ফি পাওয়া যায়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই কাঠামো প্রকল্প দ্রুত সম্পন্ন করার চাপ তৈরি করে, এমনকি যদি তা সরকারের পক্ষে অনুকূল না হয় তবুও।
আইএফসির ‘লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনাল পিপিপি স্ট্রাকচার রিপোর্ট’-এ স্পষ্ট বলা হয়, বাংলাদেশের অনমনীয় ট্যারিফ নীতি আন্তর্জাতিক অপারেটরদের বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত করছে। তাই তারা ট্যারিফ বৃদ্ধির নিশ্চয়তা দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিল—যা এখন বাস্তবে পরিণত হয়েছে।
বিদেশি অপারেটরদের জন্য ‘আর্থিকভাবে আকর্ষণীয়’ বাজার
সরকার ইতোমধ্যেই ঘোষণা দিয়েছে, বে টার্মিনাল থেকে মাতারবাড়ী পর্যন্ত নতুন টার্মিনালগুলো বেসরকারি খাতে লিজ দেওয়া হবে। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে তাই বন্দর মাশুল পুনর্বিন্যাস করা হয়েছে।
বর্তমানে পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল পরিচালনা করছে সৌদি আরবভিত্তিক রেড সি গেটওয়ে টার্মিনাল (আরএসজিটিআই)। খুব শিগগিরই ডিপি ওয়ার্ল্ড নিয়ন্ত্রণ নেবে নিউ মুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি)-এর, যা একাই বন্দরের প্রায় ৪০ শতাংশ কনটেইনার পরিবহন করে।
অন্যদিকে, মায়েরস্ক নজর রেখেছে লালদিয়া টার্মিনালের দিকে—যার কাঠামো তৈরি করেছে আইএফসি।
কাদের আয় বাড়বে বেশি
বিশ্লেষণে দেখা গেছে, নতুন ট্যারিফে সিপিএ ও আন্তর্জাতিক টার্মিনাল অপারেটর—দু’জনেরই আয় বাড়বে। তবে সবচেয়ে বেশি লাভ হবে বেসরকারি অপারেটরদের।
বিদেশি অপারেটরদের হ্যান্ডলিং কার্যক্রম—ক্রেন অপারেশন, লোডিং-আনলোডিং, স্টোরেজ, রিফার প্লাগ-ইন ইত্যাদির ট্যারিফ গড়ে ১৪৪ শতাংশ বেড়েছে, যেখানে সিপিএ-সংক্রান্ত চার্জ বেড়েছে প্রায় ৭০ শতাংশ।
২০ ফুটের একটি রিফার কনটেইনারের প্লাগ-ইন চার্জ বেড়েছে ৯ ডলার থেকে ২০.৯৬ ডলারে—যা ১৩৩ শতাংশ বৃদ্ধি। এর পুরো আয় যাবে অপারেটরের পকেটে।
অন্যদিকে, পাইলটেজ ফি বেড়েছে ৩৫৭ ডলার থেকে ৮০০ ডলারে—১২৪ শতাংশ বৃদ্ধি—যার সুবিধাভোগী সিপিএ।
ডলারে ট্যারিফ, বাড়তি চাপ ব্যবসায়ীদের ওপর
সিপিএ বলছে, চার দশক ধরে কোনো হার পরিবর্তন হয়নি। কিন্তু ব্যবসায়ীরা বলছেন, ট্যারিফ ডলারে নির্ধারণ করায় তাদের খরচ আগেই বেড়ে গেছে।
২০২০ সালে ১ ডলার ছিল ৮৫ টাকা—তখন এক কনটেইনার হ্যান্ডলিং খরচ ছিল ৩,৬৫৫ টাকা। এখন ডলার ১২৪ টাকা হওয়ায় একই সেবার খরচ দাঁড়িয়েছে ৫,৩৩২ টাকা—অর্থাৎ চার বছরে ৪৫ শতাংশ বৃদ্ধি।
চট্টগ্রাম এখন বেশি ব্যয়বহুল, কিন্তু কম কার্যকর
নতুন ট্যারিফে ২০ ফুট কনটেইনারের গড় খরচ ৯৭ ডলার থেকে বেড়ে ১৩৩ ডলার হয়েছে। তুলনায় সিঙ্গাপুরে ১৮০-১৯০ ডলার ও কলম্বোতে ১৫০-২৫০ ডলার।
তবে সেসব বন্দরে দ্রুত জাহাজ ছাড়ার সুবিধা, সংযোগ ও সময়নিষ্ঠ সেবা—যা চট্টগ্রামে এখনো সীমিত।
শেষ পর্যন্ত চাপ পড়বে ভোক্তার ওপর
ব্যবসায়ীদের আশঙ্কা, এই বাড়তি খরচ শেষ পর্যন্ত আমদানি-রপ্তানিকারকদের ব্যয় বাড়াবে, যা ভোক্তা পর্যায়ে পণ্যের দামে প্রভাব ফেলবে।
তারা বলছেন, বিদেশি অপারেটররা লাভবান হলেও স্থানীয় ব্যবসায়ীরা টিকে থাকার লড়াইয়ে আরও পিছিয়ে পড়বে।
চট্টগ্রাম বন্দর বাংলাদেশের বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র। কিন্তু বিনিয়োগ আকর্ষণের নামে যদি নীতিনির্ধারণে স্বচ্ছতা ও ন্যায্যতা উপেক্ষিত হয়—তাহলে বন্দর উন্নয়নের সুফল হয়তো শেষ পর্যন্ত পৌঁছাবে না দেশের ব্যবসায়ী বা সাধারণ ভোক্তার কাছে।
প্রদা/ডিও