অর্থবছরের শুরুতে ছাত্র নেতৃত্বাধীন গণ-অভ্যুত্থান, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, উচ্চ সুদের হার এবং লাগামহীন মূল্যস্ফীতির চাপে বাংলাদেশের অর্থনীতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বড় ধাক্কা খেয়েছে। সার্বিক প্রবৃদ্ধি গত বছরের ৪.২ শতাংশ থেকে কমে ৪ শতাংশে নেমে এসেছে, যা এক দশকের মধ্যে অন্যতম নিম্নস্তর বলে জানিয়েছে বিশ্বব্যাংক।
মঙ্গলবার প্রকাশিত সংস্থার বাংলাদেশ উন্নয়ন হালনাগাদ প্রতিবেদনে বলা হয়, উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি, ঋণ সংকট, ব্যাংক খাতের অনিশ্চয়তা এবং নতুন প্রকল্পে বিনিয়োগের অনীহা অর্থনীতির গতি শ্লথ করে দিয়েছে।
অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, এই ধীরগতি শুধু প্রবৃদ্ধিকেই নয়, কর্মসংস্থান, বিনিয়োগ ও ভবিষ্যৎ উন্নয়ন সম্ভাবনাকেও গুরুতরভাবে বাধাগ্রস্ত করছে।
বিনিয়োগে মন্থরতা, ব্যাংক খাতে সংকট
প্রতিবেদনে বলা হয়, অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ব্যবসায়িক কার্যক্রমে স্থবিরতা দেখা দেয়। বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ ২২ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে আসে এবং মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি ব্যাপকভাবে কমে যায়। উচ্চ সুদের হার, ব্যয়বহুল কাঁচামাল ও অনিশ্চিত মুদ্রানীতি ব্যবসায়ীদের ঝুঁকি নিতে নিরুৎসাহ করেছে। ফলে বিনিয়োগ স্থবিরতা সার্বিক প্রবৃদ্ধিকে টেনে নামিয়েছে।
অন্যদিকে ব্যাংক খাতে অস্থিতিশীলতা অর্থনীতির দুর্বলতাকে আরও স্পষ্ট করেছে। আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে হিসাব করলে মার্চ ২০২৫ নাগাদ ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের হার দাঁড়ায় ২৪.১ শতাংশে, যা দক্ষিণ এশিয়ার গড়ের তিন গুণেরও বেশি। মূলধনঝুঁকি অনুপাত নেমে এসেছে ৬.৩ শতাংশে, যা ন্যূনতম নিয়ন্ত্রক মান ১০ শতাংশের নিচে। এই পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকার ‘ব্যাংক রেজল্যুশন অধ্যাদেশ’ জারি করেছে।
রপ্তানি ও রেমিট্যান্সে স্বস্তির ছোঁয়া
অর্থনীতির সার্বিক মন্থরতার মধ্যেও কিছু ইতিবাচক দিক দেখা গেছে। তৈরি পোশাক, চামড়া, প্লাস্টিক ও কৃষিপণ্য খাতের সাফল্যে রপ্তানি আয় বেড়েছে ৮.৮ শতাংশ। প্রবাস আয়ও ইতিহাসের অন্যতম উচ্চ পর্যায়ে উঠে এসেছে, ২৬.৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি পেয়ে। এই দুটি খাতের ইতিবাচক প্রভাবেই অর্থনীতি পুরোপুরি সংকটে না পড়ে স্থিতিশীল থাকার চেষ্টা করেছে।
কর্মসংস্থান ও রাজস্ব খাতে দুর্বলতা
শ্রমবাজারে সংকট আরও প্রকট হয়েছে। ২০২৪ সালে শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণের হার ছিল ৬০.৯ শতাংশ, যা ২০২৫ সালে নেমে দাঁড়িয়েছে ৫৮.৯ শতাংশে। বিশেষ করে নারীদের অংশগ্রহণ কমে যাওয়ায় মোট কর্মসংস্থান অনুপাত ২.১ শতাংশ কমে ৫৬.৭ শতাংশে নেমেছে। এর ফলে বেকারত্বের হার বেড়ে ৩.৭ শতাংশে পৌঁছেছে।
রাজস্ব খাতেও দুর্বলতা স্পষ্ট। কর আদায় জিডিপির অনুপাতে ৭.৪ শতাংশ থেকে কমে ৬.৮ শতাংশে নেমেছে। অন্যদিকে ভর্তুকি ও সুদের ব্যয় বেড়ে বর্তমান ব্যয় দাঁড়িয়েছে জিডিপির ৯.২ শতাংশে, আর উন্নয়ন ব্যয় কমে ৩.৩ শতাংশে। ফলে বাজেট ঘাটতি বেড়ে হয়েছে জিডিপির ৪.৭ শতাংশ।
অন্তর্বর্তী সরকার রাজস্ব সংস্কারে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছে—কর নীতি ও প্রশাসনের পৃথককরণ, কর অব্যাহতি সংস্কার এবং বাধ্যতামূলক অনলাইন রিটার্ন দাখিলের ব্যবস্থা করছে। তবে সরকারি ঋণ জিডিপির অনুপাতে আরও ভারী হয়েছে, যার প্রায় ৩৭ শতাংশ দেশীয় ব্যাংক ব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীল।
বহিঃখাতে সাময়িক উন্নতি
রেমিট্যান্স ও রপ্তানি বৃদ্ধির ফলে আট বছর পর প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ চলতি হিসাব উদ্বৃত্তে এসেছে—১৪৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। তবে আমদানি কাঠামোয় বৈষম্য রয়ে গেছে। খাদ্য ও মধ্যবর্তী পণ্যের আমদানি বেড়েছে, কিন্তু যন্ত্রপাতি ও মূলধনী পণ্যের আমদানি উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে, যা ভবিষ্যৎ বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
ভবিষ্যৎ প্রত্যাশা
বিশ্বব্যাংক বলছে, ২০২৬ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি কিছুটা ঘুরে দাঁড়াতে পারে—প্রায় ৪.৮ শতাংশে। মূল্যস্ফীতি কমলে ও ভোগব্যয় বাড়লে চাহিদা পুনরুদ্ধারের আশা রয়েছে। তবে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, ব্যাংক খাতের দুর্বলতা, সংস্কার বিলম্ব এবং জ্বালানি সরবরাহের সীমাবদ্ধতা আগামী বছরেও বিনিয়োগ পুনরুদ্ধারে বড় বাধা হয়ে থাকবে।
বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ ও ভুটান বিভাগের পরিচালক জ্যাঁ পেসমে বলেন, “বাংলাদেশের অর্থনীতি স্থিতিস্থাপকতা দেখিয়েছে, কিন্তু এটি স্বাভাবিক ধরে নেওয়া যাবে না। প্রবৃদ্ধি টিকিয়ে রাখতে কর আদায় বৃদ্ধি, ব্যাংক খাতের দুর্বলতা দূর করা, জ্বালানি ভর্তুকি হ্রাস ও বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নয়নের সংস্কার এখন সময়ের দাবি।”
প্রদা/ডিও