বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত গত কয়েক বছরে খেলাপি ঋণের চাপ, পুঁজির ঘাটতি ও প্রশাসনিক দুর্বলতায় চরম সংকটে পড়েছে। বিশেষ করে শরীয়াহভিত্তিক কিছু ব্যাংক দীর্ঘদিন ধরে অনিয়ম ও ব্যবস্থাপনাগত দুর্বলতার কারণে বাজারে টিকে থাকতে হিমশিম খাচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকার পাঁচটি ইসলামী ব্যাংক—ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক ও এক্সিম ব্যাংক—একত্র করে নতুন একটি ব্যাংক “ইউনাইটেড ইসলামী ব্যাংক” গঠনের সিদ্ধান্ত প্রায় চূড়ান্ত করেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বোর্ড ইতোমধ্যে প্রস্তাব অনুমোদন করেছে এবং নতুন ব্যাংকের প্রশাসক নিয়োগের প্রস্তুতিও চলছে। সরকারের মতে, এই পদক্ষেপের মূল লক্ষ্য ব্যাংক খাতে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা ও আমানতকারীদের আস্থা পুনরুদ্ধার করা।
খেলাপি ঋণে বিপর্যস্ত পাঁচ ব্যাংক
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন বলছে,
-
ইউনিয়ন ব্যাংকের ৯৮%,
-
ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের ৯৬%,
-
গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের ৮৬%,
-
সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের ৬২%,
-
এক্সিম ব্যাংকের ৪৮% ঋণ খেলাপি।
মোট ঋণের পরিমাণ প্রায় ১.৯৫ লক্ষ কোটি টাকা, যার মধ্যে ১.৪৭ লক্ষ কোটি টাকা আদায় অনিশ্চিত—খেলাপির হার প্রায় ৭৭%। পাশাপাশি এই ব্যাংকগুলোর মিলিত পেইড আপ ক্যাপিটাল মাত্র ৫,৮১৯ কোটি টাকা, যা দায়-দেনা ও ক্ষতির তুলনায় অতি নগণ্য।
আমানতকারীদের সুরক্ষা ও অর্থ ফেরত পরিকল্পনা
নতুন ব্যাংক গঠনের পর সর্বনিম্ন আমানতকারীদের অগ্রাধিকার দিয়ে টাকা ফেরত দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
-
২ লাখ টাকা বা তার কম আমানতকারীরা একবারে পুরো অর্থ তুলতে পারবেন।
-
বড় আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দেওয়া হবে ধাপে ধাপে।
-
প্রাতিষ্ঠানিক আমানতকারীদের ক্ষেত্রে নগদ ফেরতের বদলে নতুন ব্যাংকের শেয়ার প্রদান করা হতে পারে।
সরকার এই উদ্দেশ্যে ৩৫ হাজার কোটি টাকার পরিশোধিত মূলধন নিয়ে নতুন ব্যাংক গঠন করবে।
-
সরকার দেবে ২০ হাজার কোটি টাকা,
-
১২ হাজার কোটি আসবে আমানত বিমা তহবিল থেকে,
-
বাকি ৩ হাজার কোটি দেবে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা।
পুরনো মালিকদের শেয়ার বাতিল, নতুন কাঠামোতে সরকারি নিয়ন্ত্রণ
নতুন ব্যাংক হবে সম্পূর্ণ সরকারি মালিকানাধীন। পুরনো মালিকদের শেয়ার বাতিল হয়ে যাবে, তবে তাদের দায় ও ঋণ নতুন ব্যাংকের অধীনে স্থানান্তরিত হবে। পরিচালনা পর্ষদে থাকবেন অভিজ্ঞ ব্যাংকার, শরীয়াহ বিশেষজ্ঞ ও সরকারি প্রতিনিধি।
অর্থ মন্ত্রণালয় ব্যাংক আমানত বিমা আইন সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে, যাতে ব্যাংক একীভূত হলেও আমানতকারীরা ২ লাখ টাকা পর্যন্ত ফেরত পেতে পারেন।
আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা: শিক্ষা ও সম্ভাবনা
বিশ্বের বিভিন্ন দেশেও ব্যাংক একীভূতকরণের মাধ্যমে স্থিতিশীলতা ফিরিয়েছে।
-
ভারত ২০১৭–২০২০ সালের মধ্যে ১০টিরও বেশি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক একীভূত করে শক্তিশালী ব্যাংকিং নেটওয়ার্ক গড়ে তোলে।
-
ইন্দোনেশিয়া ২০২১ সালে তিনটি ইসলামী ব্যাংক একীভূত করে সফলভাবে ইন্দোনেশিয়া ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেছে।
-
পাকিস্তানেও এমন উদ্যোগ ছিল, তবে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও দুর্বল তদারকির কারণে তা ব্যর্থ হয়।
বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশ যদি ভারতের মতো দীর্ঘমেয়াদি কৌশল ও ইন্দোনেশিয়ার মতো পেশাদার ইসলামী ব্যাংকিং কাঠামো অনুসরণ করতে পারে, তবে “ইউনাইটেড ইসলামী ব্যাংক” দেশের ব্যাংকিং খাতে নতুন আস্থার সূচনা হতে পারে।
প্রদা/ডিও