২০২৫ সালে এসে বাংলাদেশের অর্থনীতি দাঁড়িয়েছে এক জটিল দ্বৈত বাস্তবতার মুখে। একদিকে বৈশ্বিক মন্দা, মূল্যস্ফীতি ও রপ্তানিতে অনিশ্চয়তা, অন্যদিকে অবকাঠামো উন্নয়ন, বিদেশি বিনিয়োগ এবং নীতি সংস্কারের আশাবাদ।
প্রবৃদ্ধি ও সামগ্রিক চিত্র
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) সর্বশেষ Asian Development Outlook 2025 রিপোর্টে বলা হয়েছে, চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৪ শতাংশের মধ্যে থাকতে পারে, যা আগামী অর্থবছরে ৫ শতাংশে উন্নীত হতে পারে।
এডিবি জানায়, “উচ্চ মূল্যস্ফীতি, শুল্ক বৃদ্ধি ও বৈদেশিক মুদ্রা সংকটের কারণে ভোগব্যয় ও বিনিয়োগ চাপে পড়েছে।”
অন্যদিকে বিশ্বব্যাংকের বিশ্লেষণ বলছে, ২০২৪ সালে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশ প্রায় ১.৭৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে—যা মোট জিডিপির প্রায় ০.৪ শতাংশ।
মূল্যস্ফীতি ও ক্রয়ক্ষমতা সংকট
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, গড় মূল্যস্ফীতি এখন ৯.৮ থেকে ১০ শতাংশের মধ্যে। খাদ্যপণ্য, জ্বালানি ও ভাড়া বৃদ্ধির প্রভাবে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমছে।
অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক জাহিদ হোসেন বলেন, “মূল্যস্ফীতি এখন কাঠামোগত সমস্যা। উৎপাদন ব্যয় নিয়ন্ত্রণ ও সরবরাহ ব্যবস্থার সংস্কার ছাড়া সমাধান সম্ভব নয়।”
রপ্তানি ও শুল্ক চ্যালেঞ্জ
দেশের রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশ আসে তৈরি পোশাক খাত থেকে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপে অর্ডার ১২ শতাংশ পর্যন্ত কমে গেছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নেও “গ্রিন ট্রানজিশন” ও কার্বন শুল্কের কারণে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। বিজিএমইএ জানায়, এসব পরিবর্তন বাংলাদেশের পোশাক শিল্পকে বড় চাপে ফেলেছে।
বিনিয়োগ ও অবকাঠামো
বিশ্বব্যাংক জানিয়েছে, বাংলাদেশ সম্প্রতি ৮৫০ মিলিয়ন ডলারের উন্নয়ন চুক্তি করেছে বন্দর, রেল ও কর্মসংস্থান খাতে। চট্টগ্রাম ও পায়রা বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং শিল্পাঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ উন্নয়নের মাধ্যমে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানোর লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে।
তবে রেমিট্যান্স প্রবাহে হুন্ডি লেনদেনের প্রবণতা উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে বলে জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
ব্যাংক খাতের সংকট
দেশে খেলাপি ঋণ এখন ১ লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দুর্বল তদারকি ও রাজনৈতিক প্রভাব ব্যাংক ব্যবস্থাকে ঝুঁকির মুখে ফেলছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলেন, “ব্যাংক খাতে আস্থা ফেরাতে কঠোর আইনি সংস্কারই একমাত্র পথ।”
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব
অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাত ও খরায় কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। বিশ্বব্যাংক সতর্ক করেছে, তাপমাত্রা প্রতি ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়লে কৃষিজ উৎপাদন ৬ শতাংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু সহনশীল কৃষি প্রযুক্তি ও বৃষ্টিনির্ভর সেচ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে এখনই।
করণীয় ও সম্ভাবনা
অর্থনীতিবিদদের মতে, বাংলাদেশের সামনে এখন তিনটি অগ্রাধিকার—
১️⃣ নীতিগত সংস্কার ও স্বচ্ছতা বৃদ্ধি
২️⃣ রপ্তানি ও বিনিয়োগ প্রক্রিয়া সহজীকরণ
৩️⃣ দীর্ঘমেয়াদি সবুজ অর্থনৈতিক পরিকল্পনা
প্রযুক্তি, কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ, নবায়নযোগ্য শক্তি ও ফার্মাসিউটিক্যাল খাতে বিনিয়োগ বাড়ালে টেকসই প্রবৃদ্ধির নতুন দিগন্ত খুলবে।
বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন এক সন্ধিক্ষণে—যেখানে চাপও আছে, সম্ভাবনাও আছে। সঠিক পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে অর্থনীতি আবারও গতিশীল হয়ে উঠতে পারে।
প্রদা/ডিও