রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে নতুন বিনিয়োগ কম হওয়ায় ব্যাংকগুলোতে পর্যাপ্ত ডলার থাকা সত্ত্বেও দেশের বেসরকারি খাতের ব্যবসায়ীরা স্বল্পমেয়াদি বিদেশি ঋণ নেওয়ার চেয়ে পরিশোধ করেছেন বেশি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি বছরের প্রথম সাত মাসে বেসরকারি খাত স্বল্পমেয়াদি বিদেশি ঋণ নিয়েছে ১২.২১ বিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে এ সময়ে ঋণের আসল ও সুদ পরিশোধ করেছে ১২.৮২ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ ঋণ নেওয়ার চেয়ে পরিশোধ হয়েছে ৬০০ মিলিয়ন ডলারের বেশি।
তবে জুলাই মাসে বেসরকারি খাতের ব্যবসায়ীরা ১.৮২ বিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়েছেন, যা জুনে ছিল ১.৫৫ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ এক মাসের ব্যবধানে ঋণ নেওয়া বেড়েছে ২৬৭ মিলিয়ন ডলার।
একই চিত্র দেখা গেছে ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রেও। জুলাই মাসে ব্যাংকগুলো আসল ও সুদ বাবদ ১.৯৪ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করেছে, যা এক মাস আগে ছিল ১.৮৪ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ এক মাসে প্রায় ১০ মিলিয়ন ডলার বেশি পরিশোধ করেছে।
ব্যাংকাররা বলছেন, ব্যাংকগুলোতে এখন পর্যাপ্ত ডলার মজুত রয়েছে। তবে নির্বাচিত সরকার না থাকায় অনেক ব্যবসায়ী নতুন বড় ধরনের বিনিয়োগে যাচ্ছেন না। এর ফলে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি কমে গেছে, যা স্বল্পমেয়াদি বিদেশি ঋণের চাহিদা কমিয়ে দিয়েছে। ফলে এখন যে পরিমাণ ঋণ পাচ্ছেন, তার তুলনায় ব্যবসায়ীরা বেশি পরিশোধ করে দিচ্ছেন।
তারা আরও বলেন, ২০২৩-২৪ সালে ডলারের সংকট থাকায় ব্যাংকগুলোকে ব্যাপক পরিমাণ স্বল্পমেয়াদি ঋণ ডেফার (বিলম্বিত পরিশোধ) করতে হয়েছে, যার কারণে ব্যাংকগুলোকে সুদ বাবদ অতিরিক্ত পরিশোধ করতে হয়েছে। একইসঙ্গে ব্যাংকগুলোর ক্রেডিট রেটিংও কিছুটা দুর্বল হয়েছে। তাই ব্যাংকগুলো এখন অত্যন্ত সতর্ক রয়েছে, যাতে নতুন করে ওভারডিউ তৈরি না হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি বছরের জুলাই শেষে বেসরকারি খাতে স্বল্পমেয়াদি বিদেশি ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১০ বিলিয়ন ডলার, যা জানুয়ারির শেষে ছিল ৯.৮ বিলিয়ন ডলার। এর আগে টানা প্রায় আট মাস ধরে এ ঋণের পরিমাণ কমছিল।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে আগের অর্থবছরের তুলনায় আমদানি ঋণপত্র (এলসি) খোলা ও নিষ্পত্তি বেড়েছে যথাক্রমে ৭ শতাংশ ও ১৮ শতাংশ।
অন্যদিকে এ সময়ে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি ২৫ শতাংশ এবং মধ্যবর্তী পণ্য আমদানি ৬ শতাংশ কমেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২৩ সালে ডলারের বিনিময় হার বাড়তে শুরু করার পর এর প্রভাব পড়ে বেসরকারি খাতের স্বল্পমেয়াদি বিদেশি ঋণের ওপর। তখন ব্যবসায়ীরা ডলার ঋণ পরিশোধে ঝুঁকে পড়েন। কারণ, ডলারের দর বৃদ্ধিতে বিনিময় হারজনিত ঝুঁকি ও লোকসান বেড়ে যাচ্ছিল।
এর ফলে ২০২২ সালের ডিসেম্বর শেষে স্বল্পমেয়াদি বিদেশি ঋণের স্থিতি ১৬.৪২ বিলিয়ন ডলার থেকে এক বছরের ব্যবধানে প্রায় ৪.৬৩ বিলিয়ন ডলার কমে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে দাঁড়ায় ১১.৭৯ বিলিয়ন ডলার।
২০২৪ সালের শুরু থেকে এ ঋণের পরিমাণ ওঠানামার মধ্যে থাকলেও গত বছরের জুন থেকে এটি টানা কমতে শুরু করে। এর অন্যতম কারণ ছিল গত বছরের আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের ফলে সৃষ্ট রাজনৈতিক ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি এবং ডলারের বিনিময় হারের অস্থিতিশীলতা।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, জুলাইয়ে বেসরকারি খাতের স্বল্পমেয়াদি বিদেশি ঋণের ছয়টি গুরুত্বপূর্ণ উপাদানের মধ্যে বায়ার্স ক্রেডিট কমেছে ২৮৬ মিলিয়ন ডলার এবং স্বল্পমেয়াদী ঋণ বেড়েছে ১৮৪ মিলিয়ন ডলার।
বায়ার্স ক্রেডিট হলো আমদানিকারককে বিদেশি কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দেওয়া একটি স্বল্পমেয়াদি ঋণ সুবিধা, যার মাধ্যমে পণ্যের বিক্রেতাকে তাৎক্ষণিক মূল্য পরিশোধ করা যায়, কিন্তু আমদানিকারক পরে সেই ঋণ শোধ করার সুযোগ পান।
প্রদা/ডিও