পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের রেখে যাওয়া বাজেট প্রস্তাব এবং বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার অনুসরণ করেছে বলে মনে করছে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর। তবে আর্থিক স্বচ্ছতা বাড়াতে বর্তমান সরকার কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে।
পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের রেখে যাওয়া বাজেট প্রস্তাব এবং বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার অনুসরণ করেছে বলে মনে করছে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর। তবে আর্থিক স্বচ্ছতা বাড়াতে বর্তমান সরকার কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে। সরকারের আর্থিক স্বচ্ছতা বাড়াতে আন্তর্জাতিক মান অনুসারে বাজেট তৈরি, সরকারি ব্যয় ও চুক্তির বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ এবং নিরীক্ষা প্রতিবেদন সময়মতো প্রকাশ করার পরামর্শ দিয়েছে পররাষ্ট্র দপ্তর। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে প্রকাশিত ফিসক্যাল ট্রান্সপারেন্সি রিপোর্ট বা আর্থিক স্বচ্ছতা প্রতিবেদনে বাংলাদেশের জন্য এসব পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের আর্থিক স্বচ্ছতা প্রতিবেদনে বাংলাদেশের বিষয়ে বলা হয়েছে, প্রতিবেদনটি পর্যালোচনাকালে একটি অরাজনৈতিক অন্তর্বর্তী সরকার আগের সরকারের পরিবর্তে দায়িত্ব নিয়েছে যারা বাজেট প্রণয়ন করে গিয়েছিল। অন্তর্বর্তী সরকার আগের সরকারের রেখে যাওয়া বাজেট প্রস্তাব ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া অনুসরণ করেছে। তবে আর্থিক স্বচ্ছতা বাড়াতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার করেছে। আগের সরকার নির্বাহী বাজেট প্রস্তাব ও প্রণীত বাজেট অনলাইনে সাধারণ জনগণের জন্য প্রকাশ করেছে। তবে বছরের শেষ হিসাব প্রতিবেদন যৌক্তিক সময়ের মধ্যে প্রকাশ করেনি। বাজেটের তথ্য সাধারণভাবে নির্ভরযোগ্য হলেও তা আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য নীতি অনুযায়ী প্রস্তুত করা হয়নি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাজেটে সরকারের ঋণের তথ্য জনগণের জন্য প্রকাশ করা হয়েছে। বাজেট নথিতে সরকারের পরিকল্পিত ব্যয় ও রাজস্বের একটি যথেষ্ট পূর্ণাঙ্গ চিত্র উপস্থাপন করা হয়েছিল, যার মধ্যে প্রাকৃতিক সম্পদ রাজস্বও অন্তর্ভুক্ত ছিল। তবে সরকার নির্বাহী দপ্তরগুলোর সহায়ক ব্যয় আলাদাভাবে প্রকাশ করেনি এবং বাজেট রাজস্ব ও ব্যয়ের সম্পূর্ণ চিত্র প্রদান করতে ব্যর্থ হয়েছিল। জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত বাজেট নথিতে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের আর্থিক বরাদ্দ ও আয় অন্তর্ভুক্ত ছিল। সরকারের পরিবর্তনের কারণে সর্বোচ্চ নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান সরকারের হিসাব পর্যালোচনা করেনি, তবে কিছু সারসংক্ষেপমূলক তথ্য যৌক্তিক সময়ের মধ্যে প্রকাশ করেছিল। সরকারের সর্বোচ্চ নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী স্বাধীনতা অর্জন করতে পারেনি। প্রাকৃতিক সম্পদ উত্তোলন চুক্তি ও লাইসেন্স দেয়ার ক্ষেত্রে আইনগত মানদণ্ড অনুসরণ করা হলেও সরকারি ক্রয়ের ক্ষেত্রে সীমিত তথ্য দেয়া হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণের সব প্রক্রিয়া উন্মুক্ত ও স্বচ্ছভাবে করেছে। সেই সঙ্গে বিগত সরকারের নেয়া চলমান ও আগের সব সরাসরি ক্রয়পদ্ধতি স্থগিত করেছে।
সরকার আইন বা বিধিতে প্রাকৃতিক সম্পদ উত্তোলন চুক্তি ও লাইসেন্স প্রদানের মানদণ্ড ও প্রক্রিয়া নির্দিষ্ট করেছিল এবং জনসাধারণের জন্য সীমিত তথ্য সরবরাহ করেছিল। অন্তর্বর্তী সরকার সব ধরনের প্রাকৃতিক সম্পদ উত্তোলনের ক্রয়কে সম্পূর্ণ উন্মুক্ত ও স্বচ্ছ করার পদক্ষেপ নেয় এবং পূর্ববর্তী সরকারের সরাসরি আলোচনার মাধ্যমে সম্পাদিত বা চলমান সব প্রক্রিয়া স্থগিত করে।
বাংলাদেশের আর্থিক স্বচ্ছতা উন্নয়নের জন্য প্রতিবেদনে বেশকিছু সুপারিশ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে অর্থবছর শেষে বাজেট বাস্তবায়ন প্রতিবেদন যৌক্তিক সময়ের মধ্যে জনসাধারণের জন্য প্রকাশ করা; আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত নীতিমালা অনুযায়ী বাজেট নথি প্রস্তুত করা; বাজেটে নির্বাহী দপ্তরের সহায়ক ব্যয়ের বিস্তারিত আলাদা করে দেখানো, বাজেটে সরকারের রাজস্ব ও ব্যয়ের একটি সম্পূর্ণ চিত্র উপস্থাপন করা, সর্বোচ্চ নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানকে আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী স্বাধীন করা এবং বার্ষিক বাজেটের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়িত অংশে সরাসরি ও সময়মতো প্রবেশাধিকার প্রদানে পর্যাপ্ত সুবিধা সরবরাহ করা, নিরীক্ষা প্রতিবেদনগুলো সময়মতো প্রকাশ করা, যাতে কার্যকর ফলাফল, সুপারিশ ও বর্ণনা থাকে; প্রাকৃতিক সম্পদ উত্তোলন চুক্তি প্রদানের মৌলিক তথ্য জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা; এবং সরকারি কেনাকাটার চুক্তির তথ্য প্রকাশ করা।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রকাশিত আর্থিক স্বচ্ছতা প্রতিবেদনের বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আগের কাঠামো অনুসরণ না করে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে এ ধরনের পরিবর্তন আনা সম্ভব নয়। তবে প্রতিবেদনে যেসব সুপারিশ করা হয়েছে সেগুলো নিয়ে দ্বিমত করার সুযোগ নেই। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার দুটি সুপারিশ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দেয়া যেতে পারে। একটি হচ্ছে সরকারের আয় ও ব্যয়ের যে মাসিক প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয় (মান্থলি ফিসক্যাল রিপোর্ট) সেখানে ব্যয়ের অর্থনৈতিক শ্রেণীবিভাগের ক্ষেত্রে বিস্তারিত তথ্য দেয়া হয় না। তাছাড়া প্রতিবেদনগুলো অনেক দেরিতে প্রকাশ করা হয়। এক্ষেত্রে বিস্তারিত তথ্য সহকারে সময়মতো প্রতিবেদন প্রকাশ করার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে সময়মতো নিরীক্ষা প্রতিবেদন প্রকাশ করা। এসব প্রতিবেদনে যেসব আপত্তি উঠে আসে সেগুলো সমাধানে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষেত্রে সময়মতো প্রতিবেদন প্রকাশ করা জরুরি। প্রথমে এ দুটি বিষয় বাস্তবায়নে সবচেয়ে বেশি জোর দেয়া উচিত। তারপর বাকি বিষয়গুলোর দিকে নজর দিতে পারে সরকার।’
প্রদা/ডিও