চট্টগ্রামের দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথে হাতির দুর্ঘটনা এড়াতে প্রায় ৪০ কোটি টাকা ব্যয়ে এআই-চালিত সিগন্যাল প্রযুক্তিসম্পন্ন রোবোটিক ও সেন্সর ক্যামেরা স্থাপন করতে যাচ্ছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। চলতি বছরের মধ্যেই সংরক্ষিত বনের ভেতরে ছয়টি ক্যামেরা বসানো হবে।
বন্যপ্রাণীর সঙ্গে দুর্ঘটনা—বিশেষ করে হাতির সঙ্গে সংঘর্ষ—এ রেলপথে প্রায়ই ঘটে। ২০২৪ সালের অক্টোবরে চুনতি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যের কাছে একটি হাতিশাবক ট্রেনের ধাক্কায় মারা যায়। এছাড়া, চলতি বছরের জুলাইয়ে অল্পের জন্য এড়ানো যায় আরেকটি বড় দুর্ঘটনা।
রেলওয়ে ও বন বিভাগের তথ্যমতে, ১১ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ১০৩ কিলোমিটার দীর্ঘ এই রেলপথের ২৭ কিলোমিটার গেছে সংরক্ষিত বনের ভেতর দিয়ে। লোহাগাড়ার চুনতি, ফাঁসিয়াখালী ও মেধাকচ্ছপিয়া সংরক্ষিত বনের ভেতর দিয়ে রেললাইন গেছে। এ জন্য ২০৭ একর জমি সংরক্ষিত বন থেকে বাদ দেওয়া হয়।
এশিয়ান হাতিসহ বন্যপ্রাণীর চলাচলের জন্য আন্ডারপাস ও ওভারপাস নির্মাণের পরও দুর্ঘটনা ঘটছে। অনেক সময় হাতি এসব অবকাঠামো ব্যবহার না করে সরাসরি রেললাইনে উঠে আসে। ফলে ক্যামেরা স্থাপনের কার্যকারিতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন সংশ্লিষ্টরা।
রেলওয়ের তথ্য অনুযায়ী, হংকংয়ের একটি প্রতিষ্ঠানকে ছয়টি ক্যামেরা, সংকেত বাতিসহ আনুষঙ্গিক সরঞ্জাম সরবরাহের কাজ দেওয়া হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে এআই-সমৃদ্ধ ক্যামেরা আনা হবে। সংরক্ষিত বনের ভেতরে আরপিসি পোলের ওপর এসব ক্যামেরা বসানো হবে।
ক্যামেরাগুলো হাতির অবয়ব শনাক্ত করতে পারবে। হাতি বা হাতির পাল রেললাইনে উঠলে তাৎক্ষণিক ছবি আকারে সংকেত পাঠাবে। সঙ্গে সঙ্গে রেললাইনের পাশে থাকা লাল বাতি স্বয়ংক্রিয়ভাবে জ্বলে উঠবে। এতে ট্রেনচালক (লোকোমাস্টার) ৫০০-৭০০ মিটার দূর থেকেই হাতির উপস্থিতি বুঝতে পারবেন। ২২০ মিটার দূর থেকেই ট্রেন ব্রেক করার সুযোগ থাকে।
এরই মধ্যে ট্রেনচালক ও পরিচালকদের (গার্ড) এ বিষয়ে এক দফা প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।
দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথে ২০২৩ সালের ১ ডিসেম্বর থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ট্রেন চলাচল শুরু হয়। বর্তমানে এ রুটে দিনে ও রাতে চার জোড়া ট্রেন চলাচল করছে।
রেলওয়ে ও বন বিভাগের তথ্যমতে, ট্রেন চলাচল শুরু হওয়ার বছর না পেরোতেই এ রুটে ঘটে যায় হাতি দুর্ঘটনা। ২০২৪ সালের ১৩ অক্টোবর চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার চুনতি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যের এলিফ্যান্ট ওভারপাসের উত্তর পাশে ট্রেনের ধাক্কায় আহত হয়ে মারা যায় একটি হাতিশাবক। ওই ঘটনার দুদিন পর অফিস আদেশে বলা হয়, দেশের বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য ও জাতীয় উদ্যান এলাকায় ট্রেনের সর্বোচ্চ গতি ঘণ্টায় ২০ কিলোমিটার নির্ধারণ করা হয়েছে।
চলতি বছরের ২২ জুলাই রাতে একই অভয়ারণ্যে আরেকটি দুর্ঘটনা অল্পের জন্য এড়ানো সম্ভব হয়। হাতির একটি পাল রেললাইনে উঠে আসলে লোকোমাস্টার দূর থেকে তা দেখতে পান এবং হার্ড ব্রেক কষে ট্রেন থামাতে সক্ষম হন। ঘনঘন হুইসেল দিলে বিরক্ত হয়ে হাতির পালের একটি হাতি দাঁড়িয়ে থাকা ট্রেনের শেষ বগিতে ধাক্কা দেয়। তবে দ্রুত ট্রেন চালু করায় কোনো বড় ক্ষতি হয়নি।
বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের তথ্যমতে, চট্টগ্রামের লোহাগাড়া ও বাঁশখালী উপজেলা এবং কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার ১৯ হাজার ১৮৫ একর জায়গাজুড়ে বিস্তৃত চুনতি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য। একসময় গর্জনগাছপ্রধান এ বনে এখন গুটিকয়েক গর্জনগাছ অবশিষ্ট আছে। এ অভয়ারণ্যে বর্তমানে ৪০-৫০টি এশিয়ান হাতি রয়েছে, যারা লোহাগাড়া, বাঁশখালী ও চকরিয়ার বনজুড়ে চলাচল করে এবং রেললাইন পার হয়।
আন্ডারপাস-ওভারপাস নির্মাণের পরও দুর্ঘটনা
রেলওয়ের তথ্যমতে, সংরক্ষিত বনের ভেতর দিয়ে রেলপথ নির্মাণের শর্ত ছিল দুটি ওভারপাস ও দুটি আন্ডারপাস করার। তবে নির্মাণ হয়েছে একটি ওভারপাস, আর আন্ডারপাস দুটির মধ্যে একটি অকার্যকর। সাউন্ড ব্যারিয়ারও বসানো হয়নি।
রেললাইন নির্মাণের সময় কাটা ২ লাখ ৪০ হাজার গাছের বিপরীতে ৭ লাখ ২০ হাজার গাছ রোপণ করা হলেও গবেষকদের মতে অবকাঠামো অপর্যাপ্ত ও সংকুচিত।
প্রদা/ডিও