দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ টানতে চট্টগ্রাম বন্দর উন্নয়নে বড় পদক্ষেপের ঘোষণা দিয়েছিল অন্তর্বর্তী সরকার। যার মাধ্যমে উদ্যোক্তাদের কাছে চট্টগ্রাম অঞ্চল বিনিয়োগ আকর্ষণে রূপ নেয়।
দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ টানতে চট্টগ্রাম বন্দর উন্নয়নে বড় পদক্ষেপের ঘোষণা দিয়েছিল অন্তর্বর্তী সরকার। যার মাধ্যমে উদ্যোক্তাদের কাছে চট্টগ্রাম অঞ্চল বিনিয়োগ আকর্ষণে রূপ নেয়। কিন্তু বিনিয়োগ প্রস্তাবে উল্টো চিত্র দেখা যাচ্ছে, ক্রমেই চট্টগ্রাম বিভাগে বিনিয়োগ আগ্রহ কমে যাচ্ছে উদ্যোক্তাদের। গত ২০২৪-২৫ অর্থবছরে চট্টগ্রাম বিভাগে ২ হাজার ৪১৩ কোটি বিনিয়োগ প্রস্তাব এসেছে, যা ২০২২-২৩ অর্থবছরের তুলনায় ৩০ শতাংশ কম। এ অর্থবছরে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রস্তাব ছিল।
বিনিয়োগ প্রস্তাব কমে যাওয়ার পেছনে দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা, ব্যবসায়িক কর্মপরিবেশ হ্রাস, জ্বালানি সংকট, জমির উচ্চমূল্যসহ নানা কারণকে দায়ী করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা। যদিও বিনিয়োগ নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা আগের তুলনায় বেড়েছে। তবে কর্মসংস্থানে বড় হ্রাস দেখা গেছে।
বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে চট্টগ্রাম বিভাগে নিবন্ধিত বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৪১২ কোটি ৯৩ লাখ টাকা। যেখানে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে নিবন্ধিত বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ৪৫০ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। এক বছরের ব্যবধানে চট্টগ্রাম অঞ্চলে বিনিয়োগ কমে গেছে প্রায় ১ হাজার ৩৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ ৩০ শতাংশ বিনিয়োগ কমে গেছে এক অর্থবছরের ব্যবধানে। যদিও বিনিয়োগ নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা আগের চেয়ে বেড়েছে। শেষ হওয়া অর্থবছরে চট্টগ্রাম বিভাগে বিনিয়োগ নিবন্ধিত হয়েছে ১৪৬টি প্রতিষ্ঠান, যা ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ছিল ৮০টি।
বন্দরকেন্দ্রিক সুবিধা, শ্রমিকের প্রাপ্যতা, জমির সংস্থান ও অবকাঠামোগত সুবিধার কারণে বিনিয়োগকারীরা চট্টগ্রামকেই অগ্রাধিকারে রাখেন। তবে দেশের জ্বালানি সংকট, সরকার পরিবর্তন-পরবর্তী অস্থিরতা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতাসহ নানা কারণে বিনিয়োগকারীরা পিছিয়ে যাচ্ছেন। যারা নিবন্ধন নিচ্ছেন তারাও বিনিয়োগ করা নিয়ে নানা ধরনের দ্বিধাদ্বন্দ্বে রয়েছেন।
জানা গেছে, ২০১১-১২ থেকে ২০২৪-২৫ অর্থবছর পর্যন্ত চট্টগ্রামে ২ হাজার ৯৮০টি দেশী-বিদেশী প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগ নিবন্ধন নিয়েছে। সম্ভাব্য বিনিয়োগের পরিমাণ ৬৬ হাজার ৫৮৭ কোটি টাকা। এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মসংস্থান হওয়ার কথা ১ লাখ ৫৯ হাজার ৫৬৬ জনের। এর মধ্যে যৌথ বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান রয়েছে ৪৪টি ও শতভাগ বিদেশী প্রতিষ্ঠান ৩৪টি। এসব প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগের পরিমাণ মাত্র ৭৩০ কোটি টাকা এবং ১০ হাজার ৪১ জনের কর্মসংস্থান সৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। বিপরীতে ২ হাজার ৯০২টি স্থানীয় বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠানে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে ১ লাখ ৪৯ হাজার ৫২৫ জনের।
বিডার গত আট অর্থবছরের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে চট্টগ্রাম বিভাগে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ প্রস্তাব এসেছে। ওই অর্থবছরে ৭ হাজার ৮৮৭ কোটি ২৯ লাখ টাকার বিনিয়োগ নিবন্ধন ছিল। আট বছরের মধ্যে সর্বোচ্চসংখ্যাক (৩১১টি প্রতিষ্ঠান) নিবন্ধন নিয়েছিল। এর পরবর্তী ২০১৯-২০ অর্থবছর থেকে ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত বিনিয়োগ প্রস্তাব কমলেও ২০২২-২৩ অর্থবছরে পুনরায় বিনিয়োগ নিবন্ধনের পরিমাণ বাড়তে থাকে। এর মধ্যে কভিড মহামারীর কারণে ২০২০-২১ ও ২০২১-২২ অর্থবছরে বিনিয়োগে ভাটা পড়ে। ওই দুই অর্থবছরে যথাক্রমে বিনিয়োগ নিবন্ধিত হয় ২ হাজার ৪৯৭ কোটি ও ১ হাজার ৯৬০ কোটি টাকা।
বিডার তথ্যমতে, ২০২৪ সালের শেষার্ধে নিবন্ধিত বিনিয়োগের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ইউনিটেক্স এলপি গ্যাস ১৯৯ কোটি টাকা, ব্যাকসন ওয়্যার ড্রইং ইন্ডাস্ট্রি ২১ কোটি, সামুদা কেমিক্যাল কমপ্লেক্স ২৭৫ কোটি, কেডিএস থ্রেড সাড়ে ৪ কোটি, রমাহ হেলথকেয়ার ৭১ কোটি, কেডিএস অ্যাপারেলস ৬০ কোটি, কেআর স্টিল ৫৬ কোটি, বাংলাদেশ এগ্রিকালচার প্রডাক্টস ১৪ কোটি, কেডিএস গার্মেন্টস ২৫২ কোটি ও সিএসসিআর হাসপাতাল ৮৩ কোটি টাকার বিনিয়োগ নিবন্ধন নিয়েছে। ২০২৫ সালের প্রথমার্ধে উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ নিবন্ধনগুলোর মধ্যে রয়েছে পিটুপি হেলথকেয়ার পিএলসি ২১৮ কোটি টাকা, বিএসআরএম ২৭ কোটি, টিকে গ্রুপের ম্যাফ সু লিমিটেড ৪৭ কোটি, স্মার্ট কংক্রিট রেডিমিক্স ৩৯ কোটি, আলপিন ফুড অ্যান্ড বেভারেজ ৭৯ কোটি, কেআর ফ্লেক্সিপ্লাস্ট ৫০ কোটি, তাকওয়া এগ্রো ফুডস ২৭ কোটি, মীর আকসা এগ্রো ফুডস ২৫ কোটি, ফাস্ট স্ট্রিম লজিস্টিক ১০ কোটি, কেআর গ্রিন শিপ রিসাইক্লিং ৩০ কোটি, আরএমসি রিসাইক্লিং ২০ কোটি ও বে-লিংক কনটেইনারস ৮৮ কোটি টাকা।
বাংলাদেশে উচ্চসুদে ঋণ নিতে হয় উল্লেখ করে শিল্পোদ্যোক্তারা বলেন, ‘এখানে ১৪ শতাংশ সুদ দিতে হচ্ছে। এত সুদে ঋণ নিয়ে বিনিয়োগকারীরা কীভাবে ব্যবসা করবে? ব্যবসার লাভের ৪০ শতাংশই চলে যাবে সুদের চাপ সামলাতে। এটি অবাস্তব। এভাবে বিনিয়োগ হয় না। উদ্যোক্তারাও টিকতে পারেন না।’
প্রদা/ডিও