দেশের সবচেয়ে বড় চাকরির ওয়েবসাইট বিডিজবস ডটকমের তথ্য বলছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ৩৫ শতাংশ স্নাতক ৩০ বছর বয়সেও বেকার থাকেন। অথচ এই বয়স পেরিয়ে গেলে সরকারি-বেসরকারি চাকরির সুযোগ প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। তুলনায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকদের মধ্যে বেকারত্বের হার ১৪ শতাংশ এবং পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৯ শতাংশ।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক বেকারত্ব নিয়ে একাডেমিক গবেষণার চিত্রও হতাশাজনক। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৮ শতাংশ স্নাতক বেকার, ১৬ শতাংশ স্ব-উদ্যোগে কিছু করছেন, আর ১৩ শতাংশ খণ্ডকালীন কাজের পাশাপাশি পড়াশোনা চালাচ্ছেন। বেতনভুক্ত চাকরি পেয়েছেন মাত্র ৪২ শতাংশ।
সর্বোচ্চ বেকার বিশ্ববিদ্যালয় ডিগ্রিধারী
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এর সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ জানাচ্ছে, দেশে সবচেয়ে বেশি বেকার বিশ্ববিদ্যালয় ডিগ্রিধারীরা (১৩.৫৪ শতাংশ)। অন্যদিকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাহীনদের মধ্যে বেকারত্ব মাত্র ১.২৫ শতাংশ। বর্তমানে দেশে প্রায় ৯ লাখ স্নাতক বেকার, যা আট বছরে দ্বিগুণ হয়েছে।
স্নাতকের সংখ্যা বাড়ছে, চাকরি নেই
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) জানায়, প্রতি বছর প্রায় ৭ লাখ স্নাতক শ্রমবাজারে প্রবেশ করেন, যার মধ্যে ৬০ শতাংশের বেশি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজের শিক্ষার্থী। এই কলেজগুলোর পাঠ্যক্রম ও পাঠদানের মান নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে সমালোচনা আছে। অথচ সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যাও বাড়ছে—বর্তমানে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ৫৬টি, বেসরকারি ১১৬টি। কিন্তু স্নাতকদের জন্য নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়নি।
নিয়োগ বন্ধ, বিনিয়োগ কম
বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনের সভাপতি ফজলে শামীম এহসান বলেন, ব্যবসা ও বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ থাকলে বছরে সর্বোচ্চ ৩ লাখ স্নাতকের কর্মসংস্থান করা সম্ভব। কিন্তু এখন নতুন নিয়োগ প্রায় হয়নি, শুধু শূন্য পদ পূরণ হয়েছে।
অর্থনীতিবিদরাও সতর্ক করেছেন। সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, দেশের ৪৫০ বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি এত বিপুল তরুণ জনগোষ্ঠীকে ধারণ করতে পারছে না। তার মতে, বিশ্ববিদ্যালয়ে যা শেখানো হচ্ছে এবং নিয়োগকর্তাদের যা দরকার—তার মধ্যে বড় অমিল আছে।
বেকারত্ব কোন বিষয়ে বেশি
বিএ (পাশ কোর্স) স্নাতকদের বেকারত্ব সর্বোচ্চ—৩১ শতাংশ। এরপর রাষ্ট্রবিজ্ঞান (২৩ শতাংশ), গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা (২০.৫৭ শতাংশ), বাংলা (১৮.৪৯ শতাংশ) ও ইসলামের ইতিহাস (১৭.৪৫ শতাংশ)। বিপরীতে ইংরেজি, অর্থনীতি, সমাজবিজ্ঞান ও ফিন্যান্সে বেকারত্ব প্রায় নেই বললেই চলে।
কর্মসংস্থানহীন প্রবৃদ্ধি
অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি হলেও কর্মসংস্থান বাড়ছে না। কৃষিতে ৪৫ শতাংশ মানুষ কর্মরত থাকলেও খাতটির জিডিপিতে অবদান এখন ১১ শতাংশেরও কম। শিল্প খাতের অবদান ৩৭ শতাংশ হলেও কর্মসংস্থান মাত্র ১৭ শতাংশের কিছু বেশি। সেবাখাত জিডিপির অর্ধেকেরও বেশি হলেও এখানে চাকরি মাত্র ৩৮ শতাংশ।
অসংগতিপূর্ণ উন্নয়ন মডেল
পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, গত ১০-১৫ বছরের উন্নয়ন মডেল কর্মসংস্থানবান্ধব ছিল না। শিক্ষা ব্যবস্থাও চাকরির বাজারের চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রবৃদ্ধির কৌশল ও উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থাকে নতুনভাবে ঢেলে সাজানো না হলে স্নাতক বেকারত্ব আগামী দিনে দেশের অগ্রগতির জন্য বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে।
প্রদা/ডিও