চীনের সহযোগিতায় আরব সাগরের তলদেশে যৌথ সমীক্ষা চালিয়ে সম্প্রতি বিপুল পরিমাণ গ্যাসের মজুদ আবিষ্কার করেছে পাকিস্তান। তবে কী পরিমাণ গ্যাসের মজুদ সেখানে রয়েছে, তা এখনো ঘোষণা করা হয়নি।
চীনের সহযোগিতায় আরব সাগরের তলদেশে যৌথ সমীক্ষা চালিয়ে সম্প্রতি বিপুল পরিমাণ গ্যাসের মজুদ আবিষ্কার করেছে পাকিস্তান। তবে কী পরিমাণ গ্যাসের মজুদ সেখানে রয়েছে, তা এখনো ঘোষণা করা হয়নি। খাতসংশ্লিষ্টরা অবশ্য মনে করছেন, বিপুল পরিমাণ এ খনিজ সম্পদ উত্তোলন করা গেলে বৃহৎ আকারে বদলে যাবে পাকিস্তানের অর্থনীতি। গ্যাস উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার পাশাপাশি জ্বালানি খাতে আমদানিনির্ভরতা কমে যাবে। তাই আরো বিস্তৃত গ্যাস অনুসন্ধানে বিনিয়োগকারীদের আহ্বান জানাচ্ছে দেশটির সরকার। এরই মধ্যে পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ সংস্থা স্পেশাল ফ্যাসিলিটেশন কাউন্সিল (এসএফসি) প্রকল্পটিতে বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
পাকিস্তানের আগে গত বছরের জানুয়ারিতে গভীর সমুদ্রে তেল-গ্যাসের অনুসন্ধান চালিয়ে বড় সাফল্যের কথা জানায় প্রতিবেশী দেশ ভারত। দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্য অন্ধ্রপ্রদেশের উপকূল থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরত্বে গভীর সাগরে জ্বালানি তেল ও গ্যাসের বড় মজুদ আবিষ্কার করে দেশটির রাষ্ট্রায়ত্ত তেল-গ্যাস অনুসন্ধানকারী প্রতিষ্ঠান অয়েল অ্যান্ড ন্যাচারাল গ্যাস করপোরেশন লিমিটেড (ওএনজিসি)। সংস্থাটির ভাষ্য অনুযায়ী খনির কার্যক্রম শেষ হলে প্রতিদিন গড়ে ৪৫ হাজার ব্যারেল জ্বালানি তেল এবং ১০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করা যাবে। সেক্ষেত্রে ভারতের দৈনিক মোট জ্বালানি তেল উত্তোলনে খনিটি প্রায় ১১ শতাংশ অবদান রাখবে। আর গোটা ভারতের মোট গ্যাস উত্তোলনে এ অবদান হবে ১৫ শতাংশ। আবিষ্কৃত খনি থেকে প্রাক্কলন অনুযায়ী জ্বালানি উত্তোলন করা গেলে বছরে এ খাতে ভারতের সাশ্রয় হবে ১০ হাজার কোটি রুপির বেশি।
সমুদ্রসীমা নিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের বিরোধ নিষ্পত্তি হয় ২০১২ সালের মার্চে। জরিপ ও অনুসন্ধান শেষ করে বিরোধ নিষ্পত্তির পরের বছরেই বাংলাদেশের সীমানা ঘেঁষে বঙ্গোপসাগরে বিপুল পরিমাণ গ্যাস আবিষ্কার করে প্রতিবেশী দেশটি। মিয়া ও শোয়ে কূপ থেকে এরই মধ্যে কয়েক ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করা হয়েছে। নিজস্ব চাহিদার পাশাপাশি সেই গ্যাস চীনেও রফতানি করছে মিয়ানমার সরকার।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সীমানা নিষ্পত্তির পর মিয়ানমার ও ভারত গভীর সমুদ্রে জ্বালানি অনুসন্ধানে ব্যাপক বিনিয়োগ করেছে। বিদেশী কোম্পানিকে তাদের জলসীমায় টানতে পেরেছে। আর বাংলাদেশ সময়ক্ষেপণের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করেছে আমদানিনির্ভর জ্বালানি নীতি। এমনকি গভীর সাগরে জ্বালানি তেল ও গ্যাস অনুসন্ধানে আওয়ামী লীগ সরকারের ডাকা আন্তর্জাতিক দরপত্র অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে উন্মুক্ত করা হলেও কোনো বিদেশী কোম্পানির সাড়া মেলেনি। ফলে দেশের বিশাল সমুদ্র এলাকার জ্বালানি সম্ভার এখনো অনাবিষ্কৃতই থেকে গেছে।
বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে সরকারের যথাযথ ও কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া উচিত উল্লেখ করে এ জ্বালানি বিশেষজ্ঞ আরো বলেন, ‘গত বছরে দরপত্র আহ্বান করা হয়েছিল, তাতে কেন কোনো কোম্পানি আগ্রহ দেখাল না, বিষয়টি জোরালোভাবে খতিয়ে দেখা দরকার। কোথায় সংকট রয়েছে, কী করলে বিদেশী কোম্পানিগুলো আগ্রহ দেখাবে, সেজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া দরকার।’
দেশে গভীর ও অগভীর সমুদ্র সীমানায় ২৬টি ব্লক রয়েছে। এর মধ্যে গভীর সমুদ্রে ব্লক রয়েছে ১৫টি এবং অগভীর সমুদ্রে ১১টি। এসব ব্লকের মধ্যে কয়েকটিতে গ্যাস অনুসন্ধানে বিদেশী কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি হয়। এসব কোম্পানি নিজেদের বিনিয়োগ নিয়ে এগিয়ে এলেও পরে ব্লক ছেড়ে চলে যায়। সর্বশেষ অগভীর সমুদ্রের ব্লক এসএস-০৪ এবং এসএস-০৯-এ জ্বালানি তেল ও গ্যাস অনুসন্ধানে কাজ করছিল ভারতীয় কোম্পানি ওএনজিসি ভিদেশ (ওভিএল) এবং অয়েল ইন্ডিয়া লিমিটেড (ওআইএল)। কিন্তু এক দশকেরও বেশি সময় ধরে কাজ করে আশাব্যঞ্জক কোনো খবর জানাতে পারেনি। সম্প্রতি কোম্পানি দুটির পারফরম্যান্স ব্যাংক গ্যারান্টি প্রত্যাহার করেছে পেট্রোবাংলা। ফলে বাংলাদেশের জলসীমায় জ্বালানি তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে বর্তমানে আর কোনো কোম্পানির কার্যক্রম নেই।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ ইন্দোনেশিয়া, ব্রুনাই ও থাইল্যান্ড তাদের জ্বালানি খাতকেন্দ্রিক দরপত্রগুলোয় বিদেশী কোম্পানির সুযোগ-সুবিধা সুনির্দিষ্ট করায় আইওসিগুলো (অয়েল অ্যান্ড গ্যাস) এখন সেদিকেই ঝুঁকছে। আন্তর্জাতিক তেল-গ্যাস কোম্পানিগুলোতে বিনিয়োগের আহ্বান জানানো হয়েছে দক্ষিণ সুমাত্রা গ্যাঘাও ব্লকেও। ব্রুনাই সরকারের পেট্রোলিয়াম কর্তৃপক্ষও চলতি বছরের এপ্রিলে উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে তাদের সমুদ্রসীমায় নতুন বিনিয়োগকারী কোম্পানি আনার সামর্থ্য দেখিয়েছে। থাইল্যান্ডেও অফশোরের নয়টি ব্লকে ডাকা দরপত্র কিনেছে ২৫টি কোম্পানি। ভিয়েতনাম তাদের ভিন্ন দরপত্রে সেবা ও সরবরাহকারী হিসেবে জ্বালানি খাতে পেয়েছে বিভিন্ন ধরনের কোম্পানি। মালয়েশিয়া গভীর সাগরে অন্তত দুটি ভিন্ন দরপত্রে বড় সাড়া পেয়েছে। দেশটির রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি পেট্রোনাস আশা করছে, এসব দরপত্রে চলতি বছর বিদেশী কোম্পানির সঙ্গে তারা চুক্তি করতে পারবে। পূর্ব এশিয়ার দেশ চীনও তাদের কয়েকটি তেল খনি ও রিফাইনারিতে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগকারী পেতে দরপত্র আহ্বান করেছে।
দক্ষিণ-পূর্ব ও পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোয় চলতি বছরের দরপত্রে বিদেশী কোম্পানিগুলোর বড় সাড়া মিললেও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে একেবারেই ভিন্ন চিত্র। গত বছরে সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বানে সাড়া না পাওয়ায় এখন নতুন করে দ্বিতীয় দফায় দরপত্র আহ্বানের প্রস্তুতি নিচ্ছে সরকার।
জানা গেছে, সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে পুনরায় দরপত্র আহ্বান করতে কার্যক্রম চালাচ্ছে সরকারের জ্বালানি বিভাগ। বিশেষত বিদেশী কোম্পানিগুলো সমুদ্রে বহুমাত্রিক জরিপের তথ্য কিনলেও কেন দরপত্রে অংশ নেয়নি, সে বিষয়গুলো চিহ্নিত করা হচ্ছে। কোম্পানিগুলোর সঙ্গেও তারা যোগাযোগ করে বেশকিছু সমস্যার কথা জানতে পেরেছে। জ্বালানি বিভাগ সেগুলো সংশোধন ও পরিমার্জন করে সরকারের মতামত নিয়ে আবারো দরপত্রে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তারা।
পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা যায়, বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে ডাকা সবশেষ দরপত্রে (মার্চ, ২০২৪) সাতটি বিদেশী কোম্পানি নথি কিনেছিল শুরুতে। দরপত্র প্রক্রিয়া আরো প্রতিযোগিতামূলক করতে সময় বাড়ানো হয় তিন মাস। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনো বিদেশী কোম্পানি আর দরপত্রই জমা দেয়নি।
বাংলাদেশে সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান তৎপরতা দেখা যায় মূলত ২০০৮ সালের দিকে। উৎপাদন অংশীদারত্ব চুক্তি (পিএসসি) ২০০৮-এর আওতায় ২০১০ সালে গভীর সমুদ্রে দুটি ব্লকে কাজ নেয় মার্কিন কোম্পানি কনোকোফিলিপস। তারা দ্বিমাত্রিক জরিপও চালায়। কিন্তু গ্যাসের দাম বাড়ানোর দাবি পূরণ না হওয়ায় ২০১৫ সালে কাজ ছেড়ে চলে যায় কোম্পানিটি। এরপর পিএসসি-২০১২-এর অধীনে ২০১৪ সালে অগভীর সমুদ্রের দুটি ব্লকে চুক্তি করে ভারতের ওএনজিসি ভিদেশ। আর দুটি ব্লকে চুক্তি করে অস্ট্রেলিয়ার স্যান্তোস ও সিঙ্গাপুরের ক্রিস এনার্জির সমন্বয়ে গঠিত যৌথ কোম্পানি। এ অঞ্চলে ব্যবসা গুটিয়ে নেয়ার কথা বলে ২০২০ সালে চলে যায় স্যান্তোস। অন্যদিকে দরপত্র ছাড়াই বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইনের অধীনে ২০১৬ সালে সমুদ্রে দুটি ব্লকে গ্যাস অনুসন্ধানে চুক্তি করে দক্ষিণ কোরিয়ার পস্কো দাইয়ু। তারাও নির্ধারিত সময়ের আগে বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যায়।
এরপর এক দশকের বেশি সময় দেশের সমুদ্র ব্লকগুলোতে বিদেশী কোম্পানিকে কাজ দেয়া যায়নি। বিশেষ করে দেশের গ্যাস সংকট শুরু হলে বিশ্ববাজার থেকে এলএনজি আমদানি করে ঘাটতি মেটানোর চেষ্টা করা হয়েছে। বিশেষ করে ২০১৮ সালের পর থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত অন্তত দেড় লাখ কোটি টাকার জ্বালানি পণ্যটি আমদানি করা হয়েছে। সহজ পথে এলএনজি কিনতে গিয়ে দেশের সমুদ্র অংশে মনোযোগে অনীহা ছিল পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের।
যে কারণে সাগরে দীর্ঘদিনের এ স্থবিরতা বিদেশী কোম্পানিগুলোকে আর বিনিয়োগ আকর্ষণ বাড়াতে পারেনি বলে মনে করেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা।
প্রদা/ডিও