আন্তঃসীমান্ত বিদ্যুৎ বাণিজ্যের আওতায় প্রতিবেশী দেশ ভারত ও নেপালের সঙ্গে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ আমদানি চুক্তি রয়েছে মোট ২ হাজার ৮০০ মেগাওয়াটের। বিদ্যুতের চাহিদা পূরণে বর্তমানে এর ৮০ শতাংশ পর্যন্ত আমদানি করা হচ্ছে।
আন্তঃসীমান্ত বিদ্যুৎ বাণিজ্যের আওতায় প্রতিবেশী দেশ ভারত ও নেপালের সঙ্গে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ আমদানি চুক্তি রয়েছে মোট ২ হাজার ৮০০ মেগাওয়াটের। বিদ্যুতের চাহিদা পূরণে বর্তমানে এর ৮০ শতাংশ পর্যন্ত আমদানি করা হচ্ছে। অন্যদিকে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা রয়েছে দৈনিক ৬ হাজার ১১৪ মেগাওয়াট। কিন্তু এ সংস্থার কাছ থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বিদ্যুৎ কেনা হয়েছে মোট ব্যবহারের মাত্র প্রায় সাড়ে ১৬ শতাংশ। এ কারণে ওই অর্থবছরে সংস্থাটির বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর প্লান্ট ফ্যাক্টর ৩০ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। এতে কম বিদ্যুৎ সরবরাহ করার পরও বিরাট জনবলের পেছনে সংস্থাটিকে বড় আর্থিক ব্যয় বহন করতে হচ্ছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
বিদ্যুৎ উৎপাদনে ‘প্লান্ট ফ্যাক্টর’ একটি পরিমাপক সূচক, যা দেখায় একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র তার স্থাপিত ক্ষমতার তুলনায় কত শতাংশ সময়ে এবং কত দক্ষতার সঙ্গে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। সাধারণত একটি কেন্দ্র ৮০ শতাংশ প্লান্ট ফ্যাক্টরে চলবে এমন পরিকল্পনা থেকেই বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিপিডিবিসহ রাষ্ট্রায়ত্ত অন্য সংস্থাগুলোর বিদ্যুৎ কেন্দ্র বসে থাকার বড় কারণ বেসরকারি খাত থেকে বিদ্যুৎ কেনা ও আমদানিনির্ভরতা বাড়িয়ে দেয়া। ব্যয়সাশ্রয়ী বিদ্যুৎ কেন্দ্র বসিয়ে রেখে বেসরকারি কেন্দ্রগুলোর কাছ থেকে উচ্চ দামে বিদ্যুৎ কেনা হচ্ছে। এতে সামগ্রিকভাবে বিপিডিবির আর্থিক ব্যয় বাড়ছে। বসে থাকছে সংস্থাটির বিপুল সক্ষমতা।
২০২৪-২৫ অর্থবছরের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিপিডিবির অংশগ্রহণ প্রকৃতপক্ষে কত তা নির্দিষ্ট করে বলতে পারেননি সংস্থাটির কর্মকর্তারা। তবে শেষ হওয়া অর্থবছরে বিপিডিবির নিজস্ব কেন্দ্রের উৎপাদন ২০২৩-২৪ অর্থবছরের তুলনায় খুব বেশি নয় বলে জানিয়েছেন তারা।
দেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থাপনা নিরবচ্ছিন্ন রাখতে আমদানীকৃত বিদ্যুতের সর্বোচ্চ ব্যবহার করছে বিপিডিবি। মোট ২ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তির মধ্যে শুধু ভারতের আদানি গোষ্ঠীর সঙ্গে রয়েছে ১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াটের। বর্তমানে আদানির কেন্দ্র থেকে গড়ে ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আসছে। এছাড়া সরকারি জিটুজি চুক্তির আওতায় ১ হাজার ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের মধ্যে আমদানি করা হচ্ছে এক হাজার মেগাওয়াট। এছাড়া নেপাল থেকে ৪০ মেগাওয়াট জলবিদ্যুতের মধ্যে গড়ে প্রতিদিন ৩৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আসছে দেশে।
আমদানীকৃত বিদ্যুৎ বেশি কেনার ফলে একদিকে যেমন বেশি বিদেশী বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করতে হচ্ছে, অন্যদিকে স্থানীয় কেন্দ্র বসিয়ে রেখেও ক্যাপাসিটি চার্জ বাড়ছে সরকারের। বিদ্যুৎ খাতে দেশীয় সক্ষমতার বড় অংশ বসিয়ে রেখে আদানিসহ ভারতের উৎপাদনকৃত বিদ্যুৎনির্ভরতা দেশের বিদ্যুৎ খাতে ব্যয় বাড়াচ্ছে বলে মনে করেন জ্বালানি খাতসংশ্লিষ্টরা।
বিপিডিবির আর্থিক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ছিল ৯৫ হাজার ৯৯৬ মিলিয়ন কিলোওয়াট-ঘণ্টা। এর মধ্যে বিপিডিবির নিজস্ব কেন্দ্রগুলোর উৎপাদন ছিল ১৫ হাজার ৮৩১ মিলিয়ন কিলোওয়াট-ঘণ্টা, যা মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের মাত্র সাড়ে ১৬ শতাংশ।
বিপিডিবির আওতায় মোট ৫০টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে বলে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের হিসাবে উল্লেখ করা হয়। যেগুলোর মোট প্লান্ট ফ্যাক্টর গড়ে ৩০ শতাংশ। তবে তার মধ্যে ২২টি কেন্দ্র এ বছরে কোনো বিদ্যুৎ উৎপাদন করেনি, যেগুলোর প্লান্ট ফ্যাক্টর শূন্য। বিপিডিবির ৩০ শতাংশ প্লান্ট ফ্যাক্টরের এ হিসাব সংস্থাটির যেসব কেন্দ্র উৎপাদনে ছিল তার ওপর ভিত্তি করে। কিন্তু যেসব কেন্দ্র চলেনি সেগুলো হিসাবে ধরলে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বিপিডিবির প্লান্ট ফ্যাক্টর ১৮ শতাংশের বেশি নয়।
বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয়ে বিপিডিবির নিজস্ব কেন্দ্রের আর্থিক হিস্যাও কমে এসেছে। মোট ১ লাখ ৬ হাজার কোটি টাকার বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয়ে বিপিডিবির হিস্যা মাত্র ১৩ হাজার ৪০২ কোটি টাকা। আইপিপি, ভাড়াভিত্তিক ও ভারত থেকে আমদানিতে বিদ্যুৎ ক্রয় বাবদ ব্যয় ছিল ৯০ হাজার ৪৮৮ কোটি টাকার বেশি। এছাড়া অন্যান্য আরো আড়াই হাজার কোটি টাকা ব্যয় রয়েছে।
বিপিডিবির গ্যাসভিত্তিক ২১টি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মোট সক্ষমতা ৪ হাজার ২৭৮ মেগাওয়াট। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্লান্ট ফ্যাক্টর ছিল ৩২ শতাংশ। সৌর, জল ও বায়ুবিদ্যুতের ছয়টি কেন্দ্রের মোট সক্ষমতা ২৪২ মেগাওয়াট। আলোচিত অর্থবছরে এ কেন্দ্রগুলোর প্লান্ট ফ্যাক্টর ছিল জলবিদ্যুতে ৪১ শতাংশ, বায়ুবিদ্যুতে শূন্য ও সৌরবিদ্যুতে ১৩ শতাংশ। এছাড়া ফার্নেস অয়েলভিত্তিক কেন্দ্রগুলোর মোট সক্ষমতা ৭৪২ মেগাওয়াট। যেগুলো বছরে গড়ে মাত্র ১৭ শতাংশ প্লান্ট ফ্যাক্টরে চলেছে। আর ডিজেলচালিত কেন্দ্রগুলোর সবগুলোয় এখন সারা বছর উৎপাদন বন্ধ থাকে।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিপিডিবির বেশির ভাগ বিদ্যুৎ কেন্দ্র পুরনো ও জ্বালানি সংকটের অভাবে বন্ধ থাকলেও এগুলো পরিচালনায় বিপুল জনবল নিয়োজিত রয়েছে। আর্থিক সংকটে বছরের পর বছর ধুঁকতে থাকা সংস্থাটির জনবলের পেছনে ব্যয় কমিয়ে আনার পরিকল্পনা করা উচিত। সেই সঙ্গে অদক্ষ বিদ্যুৎ কেন্দ্র উৎপাদন তালিকা থেকে বাদ দিয়ে প্রকৃত সক্ষমতা কত সেটি নিরূপণ করা প্রয়োজন।
বিপিডিবির নিজস্ব কেন্দ্রগুলোর উৎপাদন কমে যাওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেননি সংস্থাটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। সেই সঙ্গে ব্যয় সংকোচন নীতি গ্রহণ ও গ্যাস সংকট বিপিডিবির উৎপাদন সংকটের বড় কারণ বলে মনে করেন তারা।
বিপিডিবির বৃহৎ সক্ষমতার বড় অংশই উৎপাদনে নেই। কিন্তু এগুলোর পেছনে বড় জনবল নিয়োজিত রয়েছে। এ জনবল ব্যয় কমিয়ে আনতে বিপিডিবির পরিকল্পনা বিষয়ে জানতে চাইলে শীর্ষ এ কর্মকর্তা জানান, ‘যেসব বিদ্যুৎ কেন্দ্র চলে না, সেখানে কীভাবে প্রয়োজনীয় জনবল রেখে বাকি খরচ কমানো যায় সেই চেষ্টা বরাবরই রয়েছে। কারণ বিপিডিবি খরচ কমাতে চায়।’
বিপিডিবির আর্থিক চাপ ও সংস্থাটির বিপুল জনবলের ব্যয়ভার কমিয়ে আনার বিষয়ে মতামত জানতে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানের সঙ্গে তাৎক্ষণিকভাবে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু গতকাল রাতে এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
প্রদা/ডিও