বাংলাদেশে ‘পুশব্যাক’ করা হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদের বাঙালি শ্রমিক মেহেব শেখকে। তিনি ফিরে এসেছেন ভারতে।
জীবিত আছেন ঠিকই, তবে জীবিকার পথ তার সামনে এখন বন্ধ। গত চার মাস আগে মুম্বাই পুলিশের হাতে আটক হন মেহেব শেখ। তাকে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী বলে অভিযুক্ত করা হয়। ভারতীয় নথি আধার কার্ড ও ভোটার কার্ড দেখিয়েও মেহেব নিজেকে ভারতীয় প্রমাণ করতে পারেননি। পুলিশ ও সীমান্তরক্ষী বাহিনী তার সমস্ত দলিলপত্র ধুলোয় ফেলে দিয়ে বন্দুকের মুখে বাংলাদেশে ‘পুশইন’ করে। ভারতীয় নাগরিক হয়েও বহিষ্কৃত হতে হয় মেহেবকে।
ঘটনাটি ঘটেছিল ৯ জুন মুম্বাইয়ের মীরা রোডে। এক চায়ের দোকান থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় মেহেব শেখকে। মাত্র চার দিনের মধ্যে তাকে রাতের অন্ধকারে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। পরে তিনি ভারতে ফিরে এলেও আগের মতো কাজ পাননি। যেতে পারেননি মুম্বাইতে। জীবিকা হারিয়ে পরিবার নিয়ে মেহেব শেখ আজ চরম অনিশ্চয়তায় ভুগছেন। বর্তমানে তার ঠিকানা পশ্চিমবঙ্গ। মেহেবের দাবি, ‘সত্যিই যদি বাংলায় কাজ থাকত তাহলে কি ভিনরাজ্যে যেতে হতো?’
তবে শুধু মেহেব শেখ নয়। এই অভিজ্ঞতা বাংলার আরও বহু বাঙালি শ্রমিকের। পশ্চিমবঙ্গ ও সীমান্ত লাগোয়া জেলাগুলো থেকে বহু বাঙালি শ্রমিককে একইভাবে সন্দেহের চোখে দেখা হচ্ছে— এমন অভিযোগ পশ্চিমবাংলায় ফিরে আসা বহু শ্রমিকের।
সম্প্রতি ভারতর উড়িষ্যায় কাজ করতে যাওয়া ফজর মণ্ডল ও তার স্ত্রীকেও ভারতীয় নথি থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল। রাজস্থানে কর্মরত ১৯ বছরের আমির শেখও এই একই অভিজ্ঞতার শিকার হয়। তার অভিযোগ, রাজস্থান পুলিশ বুটের আঘাতে তার পা চূর্ণ করে দেয়। পরে পুশব্যাক করেছিল বাংলাদেশে। বাংলাদেশের আদালত থেকে জামিন পাওয়ার পর বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) আমিরকে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দেয়। এরপর সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) তাকে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে। বসিরহাট হয়ে শেষ পর্যন্ত মালদার কালিয়াচক থানায় নথিভুক্তির প্রক্রিয়া শেষে তিনি বাড়ি ফেরেন।
দিল্লিতেও একাধিক ইটভাটায় কর্মরত পশ্চিমবঙ্গের পরিবার, যাদের কাছে আধার কার্ড, ভোটার কার্ড সবই ছিল—তারাও ‘অবৈধ’ বিদেশি হয়ে শরণার্থী শিবিরে দিন কাটিয়েছেন। তারমধ্যে দুই পরিবারকে পুশইন করা হয় বলে অভিযোগ।
গত ২৮ জুলাই পশ্চিমবঙ্গের পরিযায়ী শ্রমিক উন্নয়ন পর্ষদের চেয়ারম্যান সামিরুল ইসলাম অভিযোগ করেন, দিল্লির দুটি বাঙালি পরিবারকে আসাম সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছে। এই পরিবার দুটির মধ্যে একটি হলো বীরভূমের পাইকর থানার সুইটি বিবি, কুরবান শেখ ও ইমাম শেখ। আরেকটি পরিবার মুরারই থানার দানিস শেখ, সোনালী বিবি ও সাবির শেখ।
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান বলছে, অনেক ভারতীয় মুসলিম নাগরিককে জোর করে বাংলাদেশে পুশইন করে দেওয়া হচ্ছে। আন্তর্জাতিক ও ভারতীয় মানবাধিকার সংস্থাগুলির মতে, এটি শুধু ভারতীয় সংবিধানের পরিপন্থি নয়, আন্তর্জাতিক আইনও লঙ্ঘন করা হচ্ছে। সংবাদ সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদনে আরও দাবি করা হয়েছে, আসামে বিশেষ অভিযানের মাধ্যমে ‘সন্দেহভাজন বিদেশিদের’ দ্রুত নির্বাসন প্রক্রিয়া চালানো হচ্ছে।
এরইমধ্যে একাধিক ঘটনায় আদালত হস্তক্ষেপ করেছে। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ইতোমধ্যে কেন্দ্রীয় সরকারকে প্রশ্ন করেছে, শুধু ভাষা বা ধর্মের ভিত্তিতে কেন মানুষকে বিদেশি বলা হচ্ছে? আদালত জানিয়েছে, বাংলা ভাষায় কথা বললেই কেউ বিদেশি হয়ে যায় না। ২৯ আগস্ট সুপ্রিম কোর্ট চরম ভর্ৎসনা করে নরেন্দ্র মোদীর সরকারকে। বিচারপতিরা বলেছেন, দেশের নিরাপত্তা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু ভারত একটি বহু ভাষাভাষীর দেশ। শুধু বাংলায় কথা বললেই কি একজন ব্যক্তিকে বাংলাদেশি বলে ধরে নেওয়া যায়? কেন্দ্রীয় সরকারকে এই বিষয়ে তাদের অবস্থান স্পষ্ট করতে হবে বলে আদালত নির্দেশ দিয়েছেন।
সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি সূর্য কান্তা, বিচারপতি জয়মাল্য বাগচী এবং বিচারপতি বিএম পাঞ্চোলির ডিভিশন বেঞ্চ রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতার কাছে জানতে চান, ‘বাংলায় কথা বলার কারণে কি ভারত সরকার কাউকে বাংলাদেশি বলতে পারে? ভারতের মতো বহু ভাষাভাষীর দেশে শুধু ভাষার জন্য কাউকে বাংলাদেশি বা বিদেশি হিসেবে চিহ্নিত করা যায়?’
তুষার মেহতার উদ্দেশে বিচারপতিরা বলেছেন, ‘আমরা চাই, আপনি পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ স্পষ্ট করুন। কেন একটি ভাষা দিয়ে কাউকে বিদেশি বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে?’
বিচারপতি জয়মাল্য বাগচী আরও প্রশ্ন, ‘একজন ব্যক্তি কোন ভাষায় কথা বলেন, তা দিয়ে কি তার নাগরিকত্বের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়?’
এই পরিস্থিতিতে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একগুচ্ছ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। শ্রমিকদের জন্য ‘শ্রমশ্রী’ প্রকল্প চালু করেছেন। মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা, বাংলায় ফিরে আসা শ্রমিকদের জন্য রেশন কার্ড, স্বাস্থ্যসেবা ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে। পাশাপাশি, মাসে ৫ হাজার রুপি করে ভাতা দেওয়ার কথাও তিনি জানিয়েছেন। তবে মমতার এই প্রতিশ্রুতিতে ক্ষুণ্ন বাঙালি শ্রমিকরা। তাদের অভিমত, বর্তমান আর্থিক মূল্যবৃদ্ধির যুগে ৫ হাজার রুপিতে কী হবে? এতে কি সংসার চলে? ভাতা বন্ধ করে বাংলায় গড়ে তোলা হোক কর্মসংস্থান। তাহলে বাঙালিদের ভিনরাজ্যে যেতে হয় না। এমন বহু ভিডিও ভাইরাল হচ্ছে, যারা বর্তমানে ভিন রাজ্যে কাজ করছেন। তারাই এইসব ভিডিও বার্তা দিচ্ছেন। সেই সব সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক ভাইরাল হচ্ছে।
পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষিত বাঙালিরা বলছেন, শুধু বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার নয়, চিরকাল বাংলাকে বঞ্চিত করে আসছে সব আমলের কেন্দ্রীয় সরকার। একইভাবে বাংলায় কর্মসংস্থান তৈরি করতে পারেনি মমতার সরকার, যার কারণে বাঙালি শ্রমিকরা এই সমস্যায় পড়ছেন। শিক্ষিকা শর্মিষ্ঠা দের অভিমত, চিরকাল ভিনরাজ্যে কাজ করতে যাওয়া বাঙালিরা কমবেশি হেনস্তার শিকার হয়ে আসছে। কংগ্রেস আমলেও হয়েছে, বিজেপির সময়ও হচ্ছে। তবে আগে এভাবে পুশইনের প্রথা ছিল না। তার অভিমত, কোনোভাবেই অস্বীকার করা যায় না যে, অনুপ্রবেশ বেড়েছে। যার বড় অংশ হয় পশ্চিমবঙ্গ সীমান্ত দিয়ে।
কলকাতা হাইকোর্টের মঞ্জুশ্রী সাহা পোদ্দার বলেছেন, মুখ্যমন্ত্রী বাঙালি ও অনুপ্রবেশকারী দিয়ে এবারের ভোটের বৈতরণী পার হতে চাইছেন। এর বাইরে আর কিছু নয়। কারণ বাংলায় না আছে শিল্প, না আছে কর্মসংস্থান। যে কারণে বাঙালিরা ভিনরাজ্যে হেনস্তা হচ্ছে। আর এই হেনস্তা শুধু বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলোয় নয়। অন্যত্রও হচ্ছে। পাঞ্জাব বা দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলো বিজেপি শাসিত নয়। সেখানেও বাংলাদেশি বলে বাঙালিদের হেনস্তা করা হচ্ছে। আগের থেকে বেড়েছে। কিন্তু বাংলার মুখ্যমন্ত্রী সেসব রাজ্যের নাম মুখেও আনবেন না। কারণ ওই রাজ্যের সরকার এবং রাজনৈতিক দলগুলো বিজেপি বিরোধী ইন্ডিয়া জোটে রয়েছে। যেই জোটের অন্যতম কাণ্ডারী স্বয়ং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ফলে বাঙালি নিধন নিয়ে মমতা যা করছেন বা বলছেন তা ‘কুমিরের কান্না’।
সব মিলিয়ে বাঙালি হেনস্তার এক বৃহত্তর সংকটের ছবি সামনে আসছে। কেবল প্রান্তিক বাঙালিদের ব্যক্তিগত দুঃখ নয়, বরং একটি গভীর সামাজিক সংকটের প্রতিচ্ছবি উঠে আসছে। ভারতীয় নাগরিকত্বের নথি থাকার পরও বারবার সন্দেহের মুখে পড়তে হচ্ছে বাংলাভাষী শ্রমিকদের। অর্থাৎ যারা পিছিয়ে পড়া মানুষ দিন আনে দিন খায় তাদের সঙ্গেই ঘটে চলেছে এসব দুর্ঘটনা। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার এই রূপ অনেককে প্রমাণহীন নির্বাসনের ভয় দেখাচ্ছে।
আর তাদের নিয়েই চলছে বাংলার রাজনীতি। এখন দেখার আদালত কী রায় দেন?
প্রদা/ডিও