চব্বিশের জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বছরে প্রবাসীদের ‘রেমিট্যান্স শাটডাউন’ ছিল সরকারের বিরুদ্ধে অভিনব প্রতিবাদ। যার প্রভাব পড়ে পুরো অর্থনীতিতে। ঠিক বিপরীত চিত্র দেখা যায় আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর। শুরু হয় রেমিট্যান্সের জোয়ার। যার জেরে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রবাসী আয়ে হয়েছে রেকর্ড।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত প্রথম আট মাসে মোট দুই হাজার ১৪৬ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স এসেছে দেশে, যা স্থানীয় মুদ্রায় প্রায় দুই লাখ ৬১ হাজার ৮১২ কোটি টাকা (প্রতি ডলার ১২২ টাকা ধরে)। এটা ২০২৪ সালের একই সময়ের তুলনায় ৪২৩ কোটি ডলার বা ৫১ হাজার ৬০৬ কোটি টাকা বেশি।
তিন বছরের মধ্যে রেমিট্যান্সে ঊর্ধ্বগতি
২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট—এই আট মাসে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ১৪৬ কোটি মার্কিন ডলার। মাসভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা যায়- জানুয়ারিতে ২১৯ কোটি ডলার, ফেব্রুয়ারিতে ২৫৩, মার্চে ৩৩০ (সর্বোচ্চ), এপ্রিলে ২৭৫, মে মাসে ২৯৭, জুনে ২৮২, জুলাইয়ে ২৪৮ এবং আগস্টে ২৪২ কোটি ডলার।
অন্যদিকে, ২০২৪ সালের প্রথম ৮ মাসে রেমিট্যান্স আসে এক হাজার ৭২৩ কোটি ডলার, যার মাসভিত্তিক পরিমাণ ছিল- জানুয়ারিতে ২১১ কোটি ডলার, ফেব্রুয়ারিতে ২১৬, মার্চে ২০০, এপ্রিলে ২০৪, মে মাসে ২২৫, জুনে ২৫৪, জুলাইয়ে ১৯১ এবং আগস্টে ২২২ কোটি ডলার।
২০২৩ সালের একই সময়ে (জানুয়ারি–আগস্ট) দেশে এসেছিল মোট ১ হাজার ৪৬৮ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স, যার সমমান ছিল প্রায় এক লাখ ৭৯ হাজার ৯৬ কোটি টাকা। মাসভিত্তিক হিসাবে- জানুয়ারিতে ১৯৬ কোটি ডলার, ফেব্রুয়ারিতে ১৫৬, মার্চে ২০২, এপ্রিলে ১৬৮, মে মাসে ১৬৯, জুনে ২২০, জুলাইয়ে ১৯৭ এবং আগস্টে ১৬০ কোটি ডলার।
ডলারের দরের স্থিতিশীলতা মূল্যস্ফীতি কমার অন্যতম কারণ। আর এটি সম্ভব হয়েছে প্রবাসীরা দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে আরও বেশি অর্থ পাঠানোয়। হুন্ডির প্রবণতা এখন অনেকটাই কমে এসেছে।- বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান
সর্বোচ্চ রেমিট্যান্সের রেকর্ড ভাঙার বছর ২০২৫
২০২৫ সালের মার্চ মাসে দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ৩৩০ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স আসে। একই বছরের মে মাসে আসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২৯৭ কোটি ডলার। আর একই বছরের এপ্রিলে তৃতীয় সর্বোচ্চ ২৭৫ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স আসে দেশে।
এর আগে, সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স এসেছিল ২০২০ সালের জুলাইয়ে ২৫৯ কোটি ৮২ লাখ ডলার। তখন ঈদুল আজহা ও কোভিড-১৯ পরিস্থিতি প্রধান কারণ ছিল। ২০২৪ সালের জুনেও ঈদুল আজহার প্রভাবে রেমিট্যান্স বেড়ে দাঁড়ায় ২৫৩ কোটি ৮৬ লাখ ডলারে।
রিজার্ভেও অগ্রগতি
রেমিট্যান্স ও রপ্তানি বৃদ্ধির কারণে ২০২৫ সালের জুন শেষে বৈদেশিক মুদ্রার গ্রস রিজার্ভ দাঁড়ায় ৩১ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন ডলার। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফের হিসাব অনুযায়ী (বিপিএম৬) রিজার্ভ ২৬ দশমিক ৩১ বিলিয়ন ডলার। আগস্টের শুরুতে আকুর (এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়ন) ২০২ কোটি ডলার পরিশোধের পর রিজার্ভ সাময়িকভাবে কমে ২৯ দশমিক ৫৩ বিলিয়নে নামে, আর বিপিএম৬ অনুযায়ী সাম্প্রতিক রিজার্ভ ২৪ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলার। ২০২৪ সালের আগস্টে (সরকার পতনের সময়) এই রিজার্ভ ছিল ২০ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন ডলার, যা থেকে এখন অনেকটাই বেড়েছে।
অর্থবছরভিত্তিক রেমিট্যান্সপ্রবাহ
আগের সব অর্থবছর ছাড়িয়ে গেছে প্রবাসী আয়। অর্থবছর বিবেচনায় বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স এসেছে সদ্যসমাপ্ত ২০২৪-২৫ অর্থবছরে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, এই সময়ে দেশে এসেছে ৩০ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স, যা অর্থবছরের হিসাবে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ।
তার আগে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এসেছিল ২৩ দশমিক ৯১ বিলিয়ন ডলার, ২০২২-২৩ অর্থবছরে এসেছিল ২১ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলার, ২০২১-২২ অর্থবছরে এসেছিল ২১ দশমিক ০৩ বিলিয়ন ডলার এবং ২০২০-২১ অর্থবছরে এসেছিল ২৪ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, প্রবাসীরা এখন ব্যাংকিং চ্যানেলে অর্থ পাঠাতে বেশি উৎসাহী। হুন্ডি প্রতিরোধে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কঠোর অবস্থান, ডলার দরের স্থিতিশীলতা এবং প্রবাসীদের দেশপ্রেম এই রেকর্ডে ভূমিকা রেখেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক রেমিট্যান্স বৃদ্ধিকে দেশের অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত ইতিবাচক বলে মন্তব্য করেছে। সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান জাগো নিউজকে বলেন, ‘ডলারের দরের স্থিতিশীলতা মূল্যস্ফীতি কমার অন্যতম কারণ। আর এটি সম্ভব হয়েছে প্রবাসীরা দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে আরও বেশি অর্থ পাঠানোয়। হুন্ডির প্রবণতা এখন অনেকটাই কমে এসেছে।
তিনি বলেন, ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কড়াকড়ি নজরদারি ও কঠোর অবস্থান, অর্থপাচার প্রতিরোধ এবং সচেতনতা বৃদ্ধির ফলে প্রবাসীরা এখন আইনসঙ্গত উপায়ে অর্থ পাঠাতে আগ্রহী হচ্ছেন। মূল্যস্ফীতি কমে আসার অন্যতম কারণ ডলারের দরে স্থিতিশীলতা। এটি সম্ভব হয়েছে প্রবাসীদের ব্যাংকিং চ্যানেলে রেকর্ড রেমিট্যান্স পাঠানোর কারণে। হুন্ডি প্রবণতা কমেছে। পাশাপাশি কম সুদের ঋণ, রপ্তানি আয় বৃদ্ধি ও মুদ্রানীতি সহায়তার ফলে রিজার্ভ ও অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়িয়েছে।’
প্রদা/ডিও