ভারত থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর আজ থেকে অতিরিক্ত ৫০ শতাংশ শুল্ক কার্যকর করতে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। ফলে দুই দেশের বাণিজ্য সম্পর্কে বড় ধরনের ধাক্কা লাগবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
ভারত থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর আজ থেকে অতিরিক্ত ৫০ শতাংশ শুল্ক কার্যকর করতে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। ফলে দুই দেশের বাণিজ্য সম্পর্কে বড় ধরনের ধাক্কা লাগবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এর আগে চলতি মাসের শুরুর দিকে ভারতীয় পণ্যের ওপর অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছিল ওয়াশিংটন, যা আগে থেকে কার্যকর থাকা ২৫ শতাংশ শুল্কের সঙ্গে যুক্ত হয়ে মোট হার দাঁড়াচ্ছে ৫০ শতাংশে। মার্কিন প্রশাসন এ পদক্ষেপের কারণ হিসেবে ভারতের রাশিয়া থেকে অপরিশোধিত তেল আমদানি অব্যাহত রাখা ও সেটি প্রক্রিয়াজাত করে যুক্তরাষ্ট্রে রফতানির বিষয়টি উল্লেখ করেছে। বাড়তি শুল্কের নির্দেশিকার খসড়া গতকালই যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি ওয়েবসাইটে চলে এসেছে। এতে বলা হয়েছে আজ ভারতীয় সময় সকাল সাড়ে ৯টা থেকে তা কার্যকর হবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ শুল্কযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রে ভারতের মোট ৮ হাজার ৭০০ কোটি ডলারের রফতানির ৫৫ শতাংশ কমে যাবে। এতে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে পড়েছে পোশাক, তৈরি পোশাক, বস্ত্র, জুয়েলারি, রত্ন, গহনা শিল্প, চিংড়ি মাছ ও সামুদ্রিক খাবার, কার্পেট, অটোমোবাইল ক্ষেত্র। এতে লাভবান হবে ভিয়েতনাম, বাংলাদেশ ও চীনের মতো দেশগুলো। ইঞ্জিনিয়ারিং এক্সপোর্টস প্রমোশন কাউন্সিলের মতে, শুধু সেপ্টেম্বরেই যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি কমে দাঁড়াতে চলেছে ২০-৩০ শতাংশ। প্রাথমিক হিসাবে বার্ষিক রফতানি কমতে পারে ৪ হাজার কোটি ডলার। গ্লোবাল ট্রেড রিসার্চ ইনিশিয়েটিভের অজয় শ্রীবাস্তব বলেন, মার্কিন ক্রেতারা এখন মেক্সিকো, ভিয়েতনাম ও বাংলাদেশের দিকে ঝুঁকবেন বলে মনে করা হচ্ছে।
তবে ভারতে সংযোজন হওয়া আইফোনসহ ফার্মাসিউটিক্যালস ও ইলেকট্রনিকস খাতের পণ্য আপাতত এ শুল্কের বাইরে রয়েছে। এছাড়া অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ শুল্ক থেকে যেসব পণ্য অব্যাহতি পাচ্ছে, তার মধ্যে রয়েছে যাত্রীবাহী গাড়ি, লোহা ও ইস্পাত, তামাজাত পণ্য। এসব পণ্যের ওপর আগেই ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপিত রয়েছে।
রোটিং এজেন্সি এসঅ্যান্ডপি অনুমান করছে, শুল্কবৃদ্ধির ফলে ভারতের জিডিপির ১ দশমিক ২ শতাংশের সমপরিমাণ রফতানি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তবে এটি একটি এককালীন ধাক্কা হবে, যা দেশটির দীর্ঘমেয়াদি প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনাকে নিঃশেষ করে দেবে না।
এ অবস্থায় ভারত ব্রিকস অংশীদার এবং আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করার উদ্যোগ নিয়েছে। ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর মস্কো সফর করেছেন। দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের বাধা দূর করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দীর্ঘ হিমশীতল সম্পর্ক মেরামতের জন্য সাত বছরের মধ্যে প্রথম চীন সফরের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
বর্ধিত শুল্কের প্রতিক্রিয়ায় নয়াদিল্লি যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে বলছে, এ শুল্ক “অন্যায্য, অযৌক্তিক ও অগ্রহণযোগ্য”। জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় সব ধরনের পদক্ষেপ নেয়ার ঘোষণাও দিয়েছে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। নয়াদিল্লি বলছে, ভারতীয় কোম্পানিগুলো যেখানে সেরা চুক্তি পাবে সেখান থেকেই তেল কিনতে থাকবে। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, ‘যত চাপই আসুক, তা মোকাবেলার শক্তি আমরা আরো বাড়াব। সরকার ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা, কৃষক ও পশুপালকদের কোনো ক্ষতি হতে দেবে না।’
এরই মধ্যে শুল্কের প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়েছে ভারতের তৈরি পোশাক খাতে। তামিলনাড়ুর তিরুপপুরের বিশাল পোশাক রফতানি কেন্দ্র আগে থাকত জমজমাট। অথচ এখন সেখানে নেমে এসেছে নিস্তব্ধতা। এখানকার উদ্যোক্তা এন কৃষ্ণমূর্তি জানান, তার প্রায় ২০০ মেশিনের মধ্যে কেবল অল্প কয়েকটি চলছে। নতুন ডিজাইনের কাপড়ের নমুনাগুলোয় ধুলো জমে আছে। তিনি সম্প্রতি কারখানার সম্প্রসারণ প্রকল্প থামাতে বাধ্য হয়েছেন। এছাড়া নতুন নিয়োগ পাওয়া ২৫০ কর্মীকেও অব্যাহতি দিতে হয়েছে। অন্য এক কারখানায় প্রায় ১০ লাখ ডলারের অন্তর্বাস মার্কিন বাজারের জন্য প্রস্তুত থাকলেও ক্রেতা মিলছে না। এতে হাজার হাজার শ্রমিক বেকার হওয়ার ঝুঁকিতে পড়েছে।
ভারতের মোট ১৬ বিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাক রফতানির প্রায় এক-তৃতীয়াংশ তিরুপপুর থেকে আসে। এখানকার শত শত কারখানায় টার্গেট, ওয়ালমার্ট, গ্যাপ ও জারার মতো বড় মার্কিন খুচরা ব্র্যান্ডের জন্য পোশাক সরবরাহ করা হয়। কিন্তু নতুন শুল্কের ঘোষণা আসার পর থেকেই সব ধরনের অর্ডার বন্ধ হয়ে গেছে। স্থানীয় উদ্যোক্তারা বলছেন, সেপ্টেম্বরের পর থেকে উৎপাদনের মতো কোনো কাজ নাও থাকতে পারে।
এদিকে নতুন শুল্ক আরোপে বাজারে প্রতিযোগিতায় ভারতের অবস্থা আরো দুর্বল হচ্ছে। আগে যেখানে ভারতীয় শার্ট মার্কিন বাজারে ১০ ডলারে বিক্রি হতো, শুল্কসহ এখন সেটি দাঁড়াবে ১৬ দশমিক ৪০ ডলারে। এর বিপরীতে চীনে দাম ১৪ দশমিক ২০ ডলার, বাংলাদেশে ১৩ দশমিক ২০ ডলার ও ভিয়েতনামে মাত্র ১২ ডলার। এমনকি যদি শুল্ক ২৫ শতাংশেও নেমে আসে তাহলেও ভারত প্রতিদ্বন্দ্বীদের তুলনায় পিছিয়ে থাকবে।
অতিরিক্ত শুল্কের চাপ সামাল দিতে ভারত সরকার কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। যেমন কাঁচামালের আমদানিতে শুল্ক প্রত্যাহার। একই সঙ্গে বিকল্প বাজার খুঁজে পেতে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তির আলোচনাও জোরদার হয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, এ উদ্যোগ যথেষ্ট নয়।ৎ
প্রদা/ডিও