ভারতীয় প্রধান প্রধান রফতানি পণ্যে ডোনাল্ড ট্রাম্প আরোপিত গড়ে ৫০ শতাংশ শুল্ক হার কার্যকর হচ্ছে আজ। কোনো কোনো পণ্যের ক্ষেত্রে এ শুল্কহার বেড়ে ৬০ শতাংশও ছাড়িয়েছে।
ভারতীয় প্রধান প্রধান রফতানি পণ্যে ডোনাল্ড ট্রাম্প আরোপিত গড়ে ৫০ শতাংশ শুল্ক হার কার্যকর হচ্ছে আজ। কোনো কোনো পণ্যের ক্ষেত্রে এ শুল্কহার বেড়ে ৬০ শতাংশও ছাড়িয়েছে। গবেষণা সংস্থা গ্লোবাল ট্রেড রিসার্চ ইনিশিয়েটিভের (জিটিআরআই) হিসাবে, এ শুল্ক হার ভারত থেকে যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি কমাবে ৪৩ শতাংশ। বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রের বাজার ধরার জন্য ভারতের প্রতিযোগী দেশগুলোর জন্য বড় সুযোগ তৈরি করেছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশেষ করে চীনসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো প্রতিযোগিতামূলক দাম ও তুলনামূলক কম শুল্ক হারের সুযোগ নেয়ার ক্ষেত্রে এগিয়ে থাকতে পারে বলে মনে করছেন তারা।
মার্কিন হোমল্যান্ড সিকিউরিটি ডিপার্টমেন্ট থেকে গতকাল জারি করা নোটিসে বলা হয়েছে, ২৭ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রের পূর্বাঞ্চলীয় সময় রাত ১২টা ১ মিনিট থেকে ভারতীয় পণ্যের ওপর শুল্ক কার্যকর হবে
শুরুতে রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ হিসেবে ভারতের ওপর ২৫ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপ করেছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। পরে রাশিয়া থেকে জ্বালানি তেল কেনার অভিযোগে অতিরিক্ত আরো ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেন তিনি।
মার্কিন শুল্ক কার্যকর হওয়ার আগেই ভারতের বিভিন্ন খাতে এ-সংক্রান্ত আশঙ্কার ঢেউ ওঠে। কমে যায় ক্রয়াদেশ। মার্কিন শুল্ক ঢেউয়ের বড় অংশটি পড়েছে পোশাক খাতে। ভারত থেকে যুক্তরাষ্ট্রে রফতানিকৃত নিট ও ওভেন ওয়্যারের ক্ষেত্রে শুল্ক হার যথাক্রমে ৬৩ দশমিক ৯ ও ৬০ দশমিক ৩ শতাংশ। এছাড়া টেক্সটাইল খাতে প্রযোজ্য হচ্ছে ৫৯ শতাংশ শুল্ক। ভারতের তৈরি পোশাক রফতানি কেন্দ্রগুলোর অন্যতম তামিলনাড়ুর তিরুপ্পুর। এখানে প্রস্তুত হয় দেশটির ১৬ বিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাক রফতানির এক-তৃতীয়াংশ।
চলতি সপ্তাহে স্থানীয় গার্মেন্টস উদ্যোক্তা শিবা সুব্রামনিয়াম বিবিসিকে বলেন, ‘আমরা ভেবেছিলাম, ভারত হয়তো যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কোনো বাণিজ্য চুক্তি করবে। গত মাস থেকে পুরো শিল্পের উৎপাদন ও রফতানি চেইন থমকে গেছে। এভাবে চলতে থাকলে আমি কর্মীদের মজুরি দেব কীভাবে?’
ভারতীয় রফতানিকারকদের যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য সরবরাহ বাবদ মোট বার্ষিক আয়ের প্রায় অর্ধেকই আসে বড়দিন মৌসুমের রফতানি থেকে। বর্তমানে এর পরিবর্তে স্থানীয় বাজারে দীপাবলির কেনাকাটার মৌসুমের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে তাদের।
প্রতিযোগিতামূলক দামের ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ার আশঙ্কা জেগেছে ভারতের তৈরি পোশাক খাতে। আগে ভারতে তৈরি শার্ট যুক্তরাষ্ট্রে বিক্রি হতো গড়ে ১০ ডলারে। শুল্কের কারণে যা দাঁড়াবে ১৬ ডলার ৪০ সেন্ট। অন্যদিকে চীনা শার্টের দাম পড়বে ১৪ ডলার ২০ সেন্ট। তবে বাংলাদেশ ও ভিয়েতনাম থেকে যাওয়া শার্টের দাম আরো কম, যথাক্রমে ১৩ ডলার ২০ সেন্ট ও ১২ ডলার।
ভারতের ১০ বিলিয়ন ডলারের রত্ন ও গহনা রফতানি বাণিজ্যের একটি বড় অংশ যায় যুক্তরাষ্ট্রে। সাধারণ সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে ৩-৪ বিলিয়ন ডলারের গয়না রফতানি করলেও এবার ভারতীয় ব্র্যান্ডগুলো আতঙ্কিত। মুম্বাইয়ের ক্রিয়েশন জুয়েলারির মালিক আদিল কোতওয়াল বলেন, ‘আমি ৯০ শতাংশ হীরাখচিত গয়না যুক্তরাষ্ট্রে বিক্রি করি। আমার মুনাফার হার ৩-৪ শতাংশ। এমনকি অতিরিক্ত ১০ শতাংশ শুল্কও টেকানো কঠিন। কে শুল্ক বহন করবে? এমনকি মার্কিন খুচরা বিক্রেতারাও পারবে না।’
ভারত বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ চিংড়ি রফতানিকারক এবং দেশটির প্রধান বাজার যুক্তরাষ্ট্র। শুল্ক আরোপের ফলে চিংড়ির ওপর মোট শুল্ক দাঁড়িয়েছে ৬০ শতাংশে। এ শিল্পের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত আনুমানিক পাঁচ লাখ কৃষক এবং আরো ২৫ লাখ মানুষ পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে গত সোমবার আহমেদাবাদের এক জনসভায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি জানান, অর্থনৈতিক চাপ সত্ত্বেও নিজেদের সক্ষমতা আরো দৃঢ় করবে ভারত। ছোট উদ্যোক্তা, কৃষক ও পশুপালকদের কোনো ক্ষতি হতে দেবে না তার সরকার। মার্কিন শুল্কনীতির প্রতি পরোক্ষ ইঙ্গিত দিয়ে তিনি বলেন, ‘বিশ্বের আজ অর্থনৈতিক স্বার্থনির্ভর রাজনীতি চলছে, সবাই নিজেদের সুবিধার কথা ভাবছে। আমরা তা ভালো করেই দেখছি।’
রাজনৈতিক মঞ্চে নরেন্দ্র মোদির আত্মবিশ্বাস সত্ত্বেও বিশ্লেষকরা বলছেন, ৫০ শতাংশ শুল্ক এখন ভারতের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ রফতানি খাতে যেকোনো বিপর্যয় ভারতের জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে প্রভাব ফেলবে। বিগত ২০২৫ অর্থবছরে ভারতের নমিনাল জিডিপির আকার ছিল ৪ হাজার ২৭০ বিলিয়ন ডলার।
সাধারণ পরিস্থিতিতে চলতি অর্থবছরে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস রয়েছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি ৩ হাজার ৬৯০ কোটি ডলার কমে গেলে ভারতীয় অর্থনীতির বেজলাইন ধরতে হবে ৪ হাজার ২৩৩ বিলিয়ন ডলার। এর সঙ্গে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হিসাব করলে জিডিপি দাঁড়াবে ৪ হাজার ৫০৮ দশমিক ২৫ বিলিয়ন ডলারে। সেক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধির কার্যকর হার হবে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ, যা প্রাক্কলনের তুলনায় দশমিক ৯ শতাংশীয় পয়েন্ট কম।
প্রদা/ডিও