কিছুদিন আগে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির মধ্যে একটি শীর্ষ বৈঠক আয়োজনের ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন। তবে বাস্তবে এই বৈঠক আয়োজনের পরিকল্পনা এগোচ্ছে খুব ধীরগতিতে।
এরইমধ্যে, ইউক্রেনে আবারও সপ্তাহের মধ্যে অন্যতম বড় হামলা চালিয়েছে রাশিয়া। ইউক্রেনীয় কর্মকর্তাদের বরাতে জানা গেছে, রুশ বাহিনী ৫৭৪টি ড্রোন ও ৪০টি ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে। এই হামলায় দেশটিতে একজন নিহত এবং অন্তত ১৫ জন আহত হয়েছে।
ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্দ্রি সিবিহা বলেছেন, এই হামলাগুলো তুলে ধরেছে কেন যুদ্ধের অবসান ঘটানোর প্রচেষ্টা ‘এত গুরুত্বপূর্ণ’।
পুতিন-জেলেনস্কির সম্ভাব্য বৈঠকস্থলের তালিকায় জেনেভা, ভিয়েনা, বুদাপেস্ট থেকে শুরু করে ইস্তাম্বুলের নামও শোনা গেলেও এখন পর্যন্ত কোনো কিছুই চূড়ান্ত হয়নি।
উল্লেখ্য, ২০১৯ সালের পর পুতিন ও জেলেনস্কিকে কখনও একসাথে দেখা যায়নি। এর প্রায় তিন বছর পর ইউক্রেনে সর্বাত্মক আগ্রাসন শুরু করে রাশিয়া।
সম্প্রতি ডোনাল্ড ট্রাম্প জানান, তিনি এই শীর্ষ বৈঠকের ‘প্রস্তুতি শুরু’ করেছেন। সোমবার পুতিনের সঙ্গে ফোনালাপে রুশ প্রেসিডেন্ট এ ধরনের বৈঠকে সম্মত হয়েছেন বলেও জানান তিনি।
তবে বিশ্লেষকদের মতে, ট্রাম্পের এই মন্তব্য টেলিফোন আলাপচারিতার ‘অতিরিক্ত আশাবাদী ব্যাখ্যা’ হতে পারে। ক্রেমলিনের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো সুস্পষ্ট ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যায়নি, যা বৈঠক আয়োজন নিয়ে অনিশ্চয়তা আরও বাড়িয়েছে।
অন্যদিকে, ট্রাম্প হুঁশিয়ারি দিয়ে রেখেছেন, পুতিন শান্তি প্রক্রিয়ায় সহযোগিতা না করলে রাশিয়ার জন্য পরিস্থিতি ‘আরও কঠিন’ হয়ে উঠতে পারে। তবে এ বিষয়ে তিনি বিস্তারিত কিছু বলেননি।
সব মিলিয়ে, প্রাথমিক আলোচনার গুঞ্জন স্তিমিত হয়ে আসায় পুতিন ও জেলেনস্কির মধ্যে মুখোমুখি বৈঠকের সম্ভাবনাও ক্ষীণ হয়ে আসছে বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা।
আপাতদৃষ্টিতে দুই রাষ্ট্রপতির মধ্যে বৈঠকের বিষয়ে মস্কোকে আগ্রহী মনে হলেও বাস্তবে তারা এমন সব শর্ত জুড়ে দিচ্ছে, যা ইউক্রেনের পক্ষে মেনে নেওয়া প্রায় অসম্ভব।
বর্তমান পরিস্থিতিতে, রাশিয়া বা ইউক্রেন কেউই তাদের দীর্ঘমেয়াদি অবস্থান থেকে সরে আসতে প্রস্তুত নয়। দুই পক্ষই শান্তি চুক্তি স্থাপনের প্রচেষ্টা ব্যাহত করার জন্য একে অপরকে দায়ী করছে।
পুতিন ও জেলেনস্কির শীর্ষ বৈঠকের সম্ভাবনা ক্রমশ দূরবর্তী মনে হলেও, বৈঠক কোথায় হতে পারে তা নিয়ে জল্পনা চলছেই।
হোয়াইট হাউসে আলোচনার পর কূটনৈতিক উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে বুদাপেস্ট সম্ভাব্য বৈঠকস্থল হিসেবে আলোচিত হয়েছে। বলা হচ্ছে, আমেরিকাও এটি সমর্থন করছে।
বুধবার পোল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ডোনাল্ড তুস্ক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ‘এক্স’ (সাবেক টুইটার)-এ পোস্ট করে বুদাপেস্টে বৈঠক আয়োজনের বিরোধিতা করেছেন। ১৯৯৪ সালে বুদাপেস্টে এক শীর্ষ বৈঠকে কিয়েভ তার সোভিয়েত আমলের পারমাণবিক অস্ত্রগুলো রাশিয়ার কাছে হস্তান্তর করেছিল, যার বিনিময়ে রাশিয়া ইউক্রেনের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিয়েছিল। কিন্তু ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া দখল এবং ২০২২ সালের পূর্ণমাত্রার আগ্রাসনের কারণে সেই নিশ্চয়তা অর্থহীন হয়ে যায়।
ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ সুইজারল্যান্ডে শীর্ষ বৈঠকের সম্ভাবনার কথা তুলে ধরেছেন। দেশটি সামরিকভাবে নিরপেক্ষ এবং দীর্ঘকাল ধরে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার মঞ্চ হিসেবে পরিচিত। জেলেনস্কি ভিয়েনাকেও প্রস্তাব করেছেন, যেখানে কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থার সদর দপ্তর অবস্থিত।
২০২৩ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) ইউক্রেনে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে পুতিনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছিল। তবে সুইজারল্যান্ড ও অস্ট্রিয়া—উভয়ই আইসিসির সদস্য বলেছে, তিনি শান্তি আলোচনায় এলে তাকে নিরাপত্তা বা আইনি সুরক্ষা (ইমিউনিটি) দেওয়া হবে।
তুরস্কও একটি বিকল্প হিসেবে আলোচিত হচ্ছে। ইস্তাম্বুল ইতিমধ্যেই গত এপ্রিল থেকে ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে সরাসরি প্রতিনিধি পর্যায়ের তিন দফা আলোচনার আয়োজন করেছে, যদিও বন্দি বিনিময় ছাড়া সেগুলোতে আর কোনো কার্যত উন্নতি হয়নি।
ভ্যাটিকান ও সৌদি আরবকেও ইউক্রেন সম্ভাব্য বৈঠকস্থল হিসেবে উল্লেখ করেছে। ভ্যাটিকান দীর্ঘকাল ধরে নিজেকে আলোচনার জন্য উপযুক্ত স্থান হিসেবে প্রস্তাব করে আসছে, আর সৌদি আরব অতীতে কিয়েভ ও মস্কোর মধ্যে বন্দি বিনিময়ের ব্যবস্থা করেছে।
উচ্চপর্যায়ের কূটনীতির বাইরে, যুদ্ধের তীব্রতা কমার কোনো লক্ষণ নেই। বৃহস্পতিবার ইউক্রেন জানিয়েছে, তাদের সশস্ত্র বাহিনী রাশিয়ার রোস্তভ অঞ্চলের একটি তেল পরিশোধনাগার লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে। রোস্তভ অঞ্চল ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলীয় দনবাসের সীমান্তবর্তী এলাকা।
জেলেনস্কি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বলেন, ‘এখনও মস্কো থেকে কোনো সংকেত আসেনি যে তারা কোনও অর্থবহ আলোচনায় বসবে এবং এই যুদ্ধ শেষ করবে। চাপ প্রয়োজন।’
প্রদা/ডিও