মেগা প্রকল্পে ৭.৫২ বিলিয়ন বাড়তি ব্যয়ের অভিযোগ তুললেও এক বছরে নেই আর্ন্তজাতিক নিরীক্ষার উদ্যোগ।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক অবস্থা তুলে ধরতে শ্বেতপত্র কমিটি এবং অর্থনৈতিক কৌশল পুনর্নির্ধারণে একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়। তাদের প্রতিবেদনে উঠে আসে, আওয়ামী লীগ আমলে বাস্তবায়িত আটটি মেগা প্রকল্পে প্রারম্ভিক ব্যয়ের তুলনায় ৭ দশমিক ৫২ বিলিয়ন ডলার বা ৯১ হাজার ৭৪৪ কোটি টাকা (প্রতি ডলার ১২২ টাকা সমমানের ধরে) অতিরিক্ত ব্যয় হয়েছে। দুর্বল পরিকল্পনা, বাস্তবায়নে বিলম্ব এবং দুর্নীতিকে এ ব্যয় বৃদ্ধির প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। যদিও পরবর্তী সময়ে এ নিয়ে আর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি অন্তর্বর্তী সরকার। খাতসংশ্লিষ্টরা মনে করেন, দেশের বেসরকারি ব্যাংক খাতে অনিয়ম ও দুর্নীতি তদন্তে যেমন আন্তর্জাতিক নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করা হয়েছে, তেমনি মেগা প্রকল্পের বাড়তি ব্যয় নিয়েও আন্তর্জাতিক নিরীক্ষার ব্যবস্থা করা উচিত।
শ্বেতপত্র কমিটি ও টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনে আমলে নেয়া আট প্রকল্প হলো—পদ্মা সেতু, পদ্মা সেতু রেল সংযোগ, যমুনা রেলওয়ে সেতু, ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে, কর্ণফুলী টানেল, এমআরটি লাইন-৬ (উত্তরা-মতিঝিল মেট্রোরেল), বিআরটি-৩ (বিমানবন্দর-গাজীপুর বাস র্যাপিড ট্রানজিট) এবং হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনাল। শুরুর দিকে এ আট প্রকল্পের নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছিল ১১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার বা, ১ লাখ ৩৬ হাজার ৬৪০ কোটি টাকা। কিন্তু নির্মাণ শেষে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১৮ দশমিক ৬৪ বিলিয়ন ডলার বা, ২ লাখ ২৭ হাজার ৪০০ কোটি টাকায়। অর্থাৎ প্রারম্ভিক ব্যয়ের চেয়ে ৬৮ শতাংশ বা ৯০ হাজার ৭৬০ কোটি টাকা বেশি খরচ হয়েছে।
পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প নিয়ে একটি বিশেষ নিরীক্ষা করেছে মহা-হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের (সিএজি) কার্যালয়। তবে সরকারি এ প্রতিষ্ঠানের নিরীক্ষার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রায়ই প্রশ্ন ওঠে। এ পরিস্থিতিতে মেগা প্রকল্পগুলোর নিরীক্ষায় আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান নিয়োগের পরামর্শ দিচ্ছেন খাতসংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, যেহেতু সব মেগা প্রকল্প বিদেশী পরামর্শক ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয়েছে, তাই এসব প্রকল্পে অনিয়ম-দুর্নীতি ও লুটপাটের তদন্তেও আন্তর্জাতিক নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান নিয়োগ জরুরি। উদাহরণ হিসেবে তারা বেসরকারি ব্যাংক খাতে ফরেনসিক অডিটের উদ্যোগের কথা উল্লেখ করেন।
অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্রমে যদিও এমন কোনো উদ্যোগ দেখছেন না অর্থনৈতিক কৌশল পুনর্নির্ধারণের জন্য গঠিত টাস্কফোর্সের প্রধান ড. কেএএস মুর্শিদ। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক এ মহাপরিচালক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘যে টাকাটা অতিরিক্ত খরচ হয়ে গেছে, সেটা আর ফিরিয়ে আনার সুযোগ নেই। কিন্তু ভবিষ্যতে যেন এভাবে অতিরিক্ত অর্থ খরচ না হয়, সেজন্য আমরা কিছু কর্মকৌশল সুপারিশ করেছিলাম। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে, সেগুলো নিয়ে সরকার কোনো কাজ করেনি। করে থাকলেও একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে এবং আমার জানার বাইরে রয়েছে।’
আওয়ামী লীগ আমলে বাস্তবায়িত সবচেয়ে আলোচিত প্রকল্প পদ্মা সেতু। ২০০৭ সালে প্রকল্পটি অনুমোদন দেন তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার। তখন নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছিল ১০ হাজার ১৬১ কোটি টাকা। পরে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে প্রকল্পটি সংশোধন করে নির্মাণ ব্যয় ২০ হাজার ৫০৭ কোটিতে উন্নীত করে। পরবর্তী সময়ে আরো একাধিকবার সংশোধনের পর ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ৩১ হাজার কোটি টাকায়। প্রারম্ভিক ব্যয় থেকে প্রকল্পটির চূড়ান্ত ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে ২২১ শতাংশ। ১৪ হাজার ৬৪০ কোটি টাকা প্রারম্ভিক ব্যয়ে শুরু হওয়া প্রকল্পটি শেষ হয়েছে ৪৭ হাজার ৯২ কোটি টাকায়।
একইভাবে ৪৫ শতাংশ ব্যয় বেড়েছে পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পে। ৩৭ হাজার ৮২০ কোটি টাকায় শুরু হওয়া প্রকল্পটি শেষ হয় ৫৪ হাজার ৯০০ কোটি টাকায়। ব্যয় বৃদ্ধির কারণ হিসেবে নকশাগত জটিলতা, কেনাকাটায় বিলম্বকে দায়ী করা হয়েছে।
২০১৬ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে বাস্তবায়ন হওয়া যমুনা রেল সেতুতে ব্যয় বেড়েছে ৭৩ শতাংশ। ১০ হাজার ৭৮৪ কোটি ৮০ লাখ টাকায় শুরু হওয়া প্রকল্পটি শেষ হয় ১৮ হাজার ৬৮৬ কোটি টাকায়। বিলম্বিত বাস্তবায়নের কারণে মূল্য সমন্বয় এবং দরপত্র প্রতিযোগিতামূলক না হওয়াকে ব্যয় বৃদ্ধির কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
৩১ শতাংশ ব্যয় বেড়েছে ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ প্রকল্পে। এ প্রকল্পটি শুরু হয়েছিল ১৩ হাজার ৬৬৪ কোটি টাকায়। শেষ হওয়ার পর ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ১৭ হাজার ৯৩৪ কোটি টাকায়। নকশা পরিবর্তন, অতিরিক্ত ভূমি অধিগ্রহণ ব্যয়কে বৃদ্ধির কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে।
অন্যদিকে ২২ শতাংশ ব্যয় বেড়েছে কর্ণফুলী টানেল নির্মাণ প্রকল্পে। এ প্রকল্পটি শুরু হয়েছিল ১১ হাজার ৯৬০ কোটি টাকায়। শেষ হওয়ার পর ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ১৪ হাজার ৬৪০ কোটি টাকায়। ভৌগোলিক প্রতিবন্ধকতা এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতাকে ব্যয় বৃদ্ধির কারণ হিসেবে দেখানো হয়।
উত্তরা-মতিঝিল মেট্রোরেল নির্মাণ প্রকল্পটি শুরু হয়েছিল ২৫ হাজার ৬২০ কোটি টাকায়, যা শেষ হচ্ছে ৪০ হাজার ২৬০ কোটি টাকা খরচ করে। ব্যয় বৃদ্ধির হার ৫৭ শতাংশ। বিলম্বিত নির্মাণকাজের কারণে মূল্য সমন্বয় এবং জমি অধিগ্রহণে জটিলতার কারণে প্রকল্পটির ব্যয় বাড়ে বলে জানানো হয়েছে।
আওয়ামী লীগ আমলে নির্মাণকাজে চলা অব্যবস্থাপনা আর জনদুর্ভোগের কারণে সবচেয়ে বেশি আলোচিত ছিল বিমানবন্দর-গাজীপুর বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্প। এটি শুরু হয়েছিল ৫ হাজার ৩৬৮ কোটি টাকায়। এখন নির্মাণ ব্যয় ৭ হাজার ৭৬ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। দুর্বল পরিকল্পনা আর অপ্রতুল ব্যবস্থাপনাকে ব্যয় বৃদ্ধির কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ৩২ শতাংশ ব্যয় বাড়লেও এখনো প্রকল্পটি শেষ হয়নি। সুফল নিয়েও রয়েছে শঙ্কা।
শাহজালাল বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্পটি শুরু হয়েছিল ১৫ হাজার ৮৬০ কোটি টাকায়। কাজ শেষ হওয়ার পর ব্যয় গিয়ে দাঁড়ায় ২৬ হাজার ৮৪০ কোটি টাকায়, বৃদ্ধির হার ৬৯ শতাংশ। প্রকল্পটির ব্যয় বাড়ার কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে নকশা পরিবর্তন, কেনাকাটায় দীর্ঘসূত্রতাকে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনে উল্লেখিত আট প্রকল্পই নয়, আওয়ামী লীগ আমলে বাস্তবায়িত বা সিংহভাগ সম্পন্ন হওয়া অন্যান্য বড় প্রকল্পকেও মানসম্পন্ন নিরীক্ষার আওতায় আনা জরুরি। এর মাধ্যমে শুধু দায় নির্ধারণই নয়, ভবিষ্যতের বড় প্রকল্পগুলোয় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা সম্ভব হবে বলে মনে করেন তারা।
দেশের অর্থনীতি চাঙ্গা এবং টেকসই উন্নয়নের কৌশল নির্ধারণে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত টাস্কফোর্সের অন্যতম সদস্য ছিলেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. সামছুল হক। দেশের ধারাবাহিক উন্নয়নের স্বার্থে প্রতিটি মেগা প্রকল্পের মানসম্পন্ন নিরীক্ষা হওয়া জরুরি মন্তব্য করে তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বাংলাদেশে প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় প্রচুর সম্পদ নষ্ট হয়। ঋণদাতা সংস্থার সঙ্গে যথাযথ চুক্তি না করতে পারা, দরপত্রের কাগজপত্র সঠিকভাবে তৈরি করতে না পারা, জমি অধিগ্রহণে বিলম্ব, ব্যবস্থাপনাগত দুর্বলতাসহ নানা কারণে এ দেশে প্রকল্প বাস্তবায়নে অতিরিক্ত ব্যয় হয়ে যায়। আবার নানা খাতে দুর্নীতি-অনিয়মও হয়। আমরা যদি এসব সমস্যা বন্ধ করতে চাই, তাহলে আমাদের প্রকল্পভিত্তিক নিরীক্ষা করতে হবে। আইএমইডি (পরিকল্পনা কমিশনের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ) এ ধরনের কিছু নিরীক্ষা করলেও সেগুলোকে খুব একটা গ্রহণযোগ্য হিসেবে ধরা হয় না। আমরা যদি প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সম্পদের অপচয়, অনিয়ম-দুর্নীতি কমিয়ে সাশ্রয়ী মূল্যে অন্যান্য দেশের মতো কাজ করতে চাই, তাহলে প্রতিটা কাজের পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে। আর এ পুনর্মূল্যায়নের কাজটি করতে হবে গ্রহণযোগ্য কোনো তৃতীয় পক্ষকে দিয়ে।’
যদিও দেশের মেগা প্রকল্পগুলোয় তৃতীয় পক্ষকে দিয়ে মানসম্পন্ন নিরীক্ষা করানোর কোনো উদ্যোগ আপাতত নেই বলে জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় এবং রেলপথ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। এ প্রসঙ্গে তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বিভিন্ন প্রকল্পে অনিয়ম-দুর্নীতি তদন্তে দুদক কাজ করছে। আলাদা করে কোনো নিরীক্ষা বা তদন্তের পরিকল্পনা আপাতত আমাদের নেই।’
প্রদা/ডিও