১৮ আগস্ট হোয়াইট হাউসে ইউরোপীয় নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে ট্রাম্প দাবি করেন, ‘আমি ছয়টি যুদ্ধ শেষ করেছি… এর কোনোটিতেই সিজফায়ার (যুদ্ধবিরতি) শব্দটি ব্যবহার করতে হয়নি।’ পরের দিন তিনি তা বেড়ে ‘সাতটি যুদ্ধে’ পৌঁছায়।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ থামাতে মধ্যস্থতার চেষ্টা করছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। চলমান প্রচেষ্টার মাঝেই তিনি তার দ্বিতীয় মেয়াদে বিভিন্ন শান্তি চুক্তির অভিজ্ঞতা তুলে ধরছেন। খবর বিবিসি’র।
১৮ আগস্ট হোয়াইট হাউসে ইউরোপীয় নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে তিনি জানান, তাকে যুদ্ধবিরতির জন্য চাপ দেওয়া হয়েছিল। সেখানে ট্রাম্প দাবি করেন, ‘আমি ছয়টি যুদ্ধ শেষ করেছি… এর কোনোটিতেই সিজফায়ার (যুদ্ধবিরতি) শব্দটি ব্যবহার করতে হয়নি।’
পরের দিন তিনি যে সংখ্যাটি উল্লেখ করেছিলেন তা বেড়ে ‘সাতটি যুদ্ধে’ পৌঁছায়।
ট্রাম্প প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়, শান্তি প্রতিষ্ঠায় ভূমিকার জন্য প্রেসিডেন্টের নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়াটা ‘এখন অনেক দেরি হয়ে গেছে’। তারা এরই মধ্যে সেই সব যুদ্ধের তালিকা প্রকাশ করেছে, যেগুলো তিনি নাকি শেষ করেছেন।
তালিকায় অন্তর্ভুক্ত কিছু সংঘাত মাত্র কয়েক দিনের ছিল, যদিও এর পেছনে দীর্ঘদিনের উত্তেজনা কাজ করেছে। একই সঙ্গে প্রশ্ন রয়ে গেছে—এসব শান্তি চুক্তি কতটা স্থায়ী হবে।
যদিও ট্রাম্প নিজেই ‘সিজফায়ার’ শব্দটি বহুবার ব্যবহার করেছেন, বিশেষত তার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্ল্যাটফর্ম ‘ট্রুথ সোশ্যাল’-এ এসব নিয়ে মন্তব্য করার সময়।
বিবিসি ভেরিফাই এসব সংঘাতের বিস্তারিত খতিয়ে দেখেছে এবং কতটা কৃতিত্ব ট্রাম্পের প্রাপ্য, তা বিশ্লেষণ করেছে।
ইসরায়েল ও ইরান
১৩ জুন ইরানের লক্ষ্যবস্তুতে ইসরায়েলের হামলার মধ্য দিয়ে শুরু হয় ১২ দিনের সংঘাত।
ডোনাল্ড ট্রাম্প নিশ্চিত করেছেন, হামলার আগে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু তাকে বিষয়টি জানিয়েছিলেন।
পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালায়। আন্তর্জাতিকভাবে এই পদক্ষেপকে সংঘাত দ্রুত সমাপ্তির পথে নেওয়া এক সিদ্ধান্ত হিসেবে দেখা হয়।
২৩ জুন ট্রাম্প সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লেখেন, ‘আনুষ্ঠানিকভাবে ইরান যুদ্ধবিরতি শুরু করবে, এবং ১২ ঘণ্টা পর ইসরায়েল যুদ্ধবিরতি শুরু করবে, এবং আর ২৪ ঘণ্টা পর আনুষ্ঠানিকভাবে ১২ দিনের যুদ্ধের অবসানকে বিশ্ব স্বাগত জানাবে।’
সংঘাত শেষ হওয়ার পর ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি দাবি করেন, তার দেশ ‘গুরুত্বপূর্ণ বিজয়’ অর্জন করেছে। তবে তিনি যুদ্ধবিরতির কথা উল্লেখ করেননি।
অন্যদিকে ইসরায়েল ইঙ্গিত দিয়েছে, নতুন হুমকি মোকাবিলায় তারা আবারও ইরানে হামলা চালাতে পারে।
ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশন থিংক ট্যাংকের সিনিয়র ফেলো মাইকেল ও’হ্যানলন বলেন, ‘স্থায়ী শান্তি বা ভবিষ্যতে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি কীভাবে পর্যবেক্ষণ করা হবে—এ নিয়ে কোনো সমঝোতা হয়নি। তাই বলা যায় এটি যুদ্ধের অবসান নয়, বরং এক ধরনের বাস্তবতাভিত্তিক যুদ্ধবিরতি। তবে এটাও মানতে হবে, যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতায় ইসরায়েল যে ইরানকে দুর্বল করেছে তা কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ।’
পাকিস্তান ও ভারত
বছরের পর বছর ধরে এই দুই পারমাণবিক শক্তিধর দেশের মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করছে। তবে গত মে মাসে ভারত-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে এক হামলার পর ফের সংঘাত শুরু হয়।
চার দিন ধরে হামলা-পাল্টা হামলার পর ট্রাম্প এক পোস্টে জানান, ভারত ও পাকিস্তান ‘পূর্ণাঙ্গ ও তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতিতে’ সম্মত হয়েছে।
তিনি বলেন, এটি সম্ভব হয়েছে ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় রাতের দীর্ঘ আলোচনার’ পর।
পাকিস্তান ট্রাম্পকে ধন্যবাদ জানায় এবং পরে তার ‘গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক হস্তক্ষেপের’ জন্য তাকে নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য তার নাম সুপারিশ করে।
তবে ভারত যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকাকে এত বড় করে দেখছে না। ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিশ্রি বলেন, ‘সামরিক অভিযান বন্ধের আলোচনা সরাসরি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যেই হয়েছে। দুই দেশের সেনাবাহিনীর মধ্যে বিদ্যমান চ্যানেলের মাধ্যমেই এই আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়।’
রুয়ান্ডা ও ডি আর কঙ্গো
বছরের শুরুতে এম২৩ বিদ্রোহী গোষ্ঠী খনিজ সমৃদ্ধ পূর্ব কঙ্গোর অঞ্চল দখলে নেওয়ার পর রুয়ান্ডা ও গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র কঙ্গোর (ডি আর কঙ্গো) দীর্ঘ দিনের বিরোধ আরও তীব্র হয়।
কয়েক দশক ধরে চলা সংঘাত সমাধানে জুন মাসে দুই দেশ ওয়াশিংটনে একটি শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করে। ট্রাম্প বলেছিলেন, এটি দুই দেশের মধ্যে এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য বাড়াতে সাহায্য করবে।
চুক্তিতে ২০২৪ সালের আগস্টে রুয়ান্ডা ও কঙ্গোর মধ্যে হওয়া যুদ্ধবিরতিকে ‘সম্মান’ করার আহ্বান জানানো হয়েছে।
সর্বশেষ চুক্তির পর থেকে দুই পক্ষই একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের অভিযোগ এনেছে, আর এম২৩ বিদ্রোহীরা (যাদের যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র রুয়ান্ডার সঙ্গে যুক্ত করেছে) শান্তি আলোচনা থেকে সরে আসার হুমকি দিয়েছে।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের প্রফেসর মার্গারেট ম্যাকমিলান বলেন, ‘কঙ্গো ও রুয়ান্ডার মধ্যে এখনও লড়াই চলছে—তাই সেই যুদ্ধবিরতি কখনও সত্যিকারভাবে কার্যকর হয়নি।’
থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়া
২৬ জুলাই ট্রাম্প ট্রুথ সোশ্যাল-এ লিখেছেন, ‘আমি এখনই থাইল্যান্ডের ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করার জন্য অনুরোধ করছি, এবং চলমান যুদ্ধের অবসান ঘটানোর জন্য।’
দুইদিন পরেই সীমান্তে এক সপ্তাহের কম সময় ধরে চলা সংঘাত শেষে ‘তাৎক্ষণিক ও নিঃশর্ত যুদ্ধবিরতি’ ঘোষণা করে দুই দেশ।
মালয়েশিয়ায় শান্তি আলোচনা অনুষ্ঠিত হলেও ট্রাম্প হুঁশিয়ারি দেন, থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়া যদি লড়াই বন্ধ না করে, তবে যুক্তরাষ্ট্রের আমদানি শুল্ক হ্রাস সংক্রান্ত আলাদা আলোচনা বন্ধ করে দেওয়া হবে। দুই দেশই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যের ওপর অত্যন্ত নির্ভরশীল।
৭ আগস্ট থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়া সীমান্তে উত্তেজনা কমানোর উদ্দেশ্যে একটি চুক্তিতে পৌঁছায়।
আর্মেনিয়া ও আজারবাইজান
উভয় দেশের নেতা বলেছিলেন, ট্রাম্পকে শান্তি চুক্তি নিশ্চিত করার প্রচেষ্টার জন্য নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া উচিত। এই চুক্তি ৮ আগস্ট হোয়াইট হাউসে ঘোষণা করা হয়।
ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশন থিংক ট্যাংকের সিনিয়র ফেলো মাইকেল ও’হ্যানলন বলেছেন, ‘আমি মনে করি তাকে (ট্রাম্প) এখানে যথেষ্ট কৃতিত্ব দেওয়া উচিত—ওভাল অফিসে স্বাক্ষরের অনুষ্ঠানই হয়তো পক্ষগুলোকে শান্তির পথে নিয়ে এসেছে।’
মার্চে দুই দেশেরই সরকার জানিয়েছিল, তারা প্রায় ৪০ বছর ধরে চলা নাগর্নো-কারাবাখ সংক্রান্ত সংঘর্ষ শেষ করতে প্রস্তুত।
২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে দুই দেশের মধ্যকার সর্বশেষ তীব্র সংঘাত দেখা দেয়। কারণ আজারবাইজান নাগর্নো-কারাবাখ অঞ্চল দখল করে, যেখানে বেশিরভাগই আর্মেনিয়ান বসতি ছিল।
মিশর ও ইথিওপিয়া
এখানে ট্রাম্পের শেষ করার মতো কোনো যুদ্ধ ছিল না, কিন্তু নীল নদের ওপর বাঁধ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে উত্তেজনা চলছে।
ইথিওপিয়ার গ্র্যান্ড ইথিওপিয়ান রেনেসাঁ বাধ নির্মাণ এই গ্রীষ্মে সম্পন্ন হয়। মিশর উদ্বিগ্ন ছিল, নীল নদ থেকে তাদের পানির সরবরাহ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
১২ বছরের মতবিরোধের পর ২৯ জুন মিশরের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ইথিওপিয়ার সঙ্গে আলোচনায় কোনো অগ্রগতি হয়নি।
ট্রাম্প বলেন, ‘যদি আমি মিশরে থাকতাম, নীলের পানি আমারই চাইতো।’ তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র খুব দ্রুত সমস্যা সমাধান করবে।
মিশর তার মন্তব্যকে স্বাগত জানিয়েছে। কিন্তু ইথিওপিয়ার কর্মকর্তারা বলছেন, এটি উত্তেজনা বাড়াতে পারে।
এখনও দুই দেশের মধ্যে কোনো আনুষ্ঠানিক চুক্তি হয়নি।
সার্বিয়া ও কসোভো
২৭ জুন ট্রাম্প দাবি করেন, তিনি দুই দেশের মধ্যে সংঘাত প্রতিরোধ করেছেন। তিনি বলেন, ‘সার্বিয়া ও কসোভো বড় যুদ্ধ করতে যাচ্ছিল। আমি বললাম, যুদ্ধ করলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কোনো বাণিজ্য হবে না। তারা বলল, হয়তো আমরা যুদ্ধ করব না।’
বালকান যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে দুই দেশ দীর্ঘদিন ধরে বিবাদে জড়িত। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উত্তেজনা বাড়েছে।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের প্রফেসর মার্গারেট ম্যাকমিলান বলেন, ‘সার্বিয়া ও কসোভো লড়াই করছে না বা একে অপরের ওপর আগুন ছুড়ছে না, তাই এখানে শেষ করার মতো কোনো যুদ্ধ ছিল না।’
ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা উল্লেখ করে হোয়াইট হাউস জানায়, ২০২০ সালে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ওভাল অফিসে দুই দেশ অর্থনৈতিক স্বাভাবিকীকরণ চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল।
কিন্তু তখন তারা যুদ্ধরত অবস্থায় ছিল না।
প্রদা/ডিও