বাংলাদেশের সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে কাজ করা ভারতীয় কোম্পানি ওএনজিসি ভিদেশ (ওভিএল) এবং অয়েল ইন্ডিয়া লিমিটেডের (ওআইএল) পারফরম্যান্স ব্যাংক গ্যারান্টি প্রত্যাহার করেছে পেট্রোবাংলা।
বাংলাদেশের সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে কাজ করা ভারতীয় কোম্পানি ওএনজিসি ভিদেশ (ওভিএল) এবং অয়েল ইন্ডিয়া লিমিটেডের (ওআইএল) পারফরম্যান্স ব্যাংক গ্যারান্টি প্রত্যাহার করেছে পেট্রোবাংলা। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন পেট্রোবাংলার কর্মকর্তারা। এদিকে ব্যাংক গ্যারান্টি প্রত্যাহারের পর কোম্পানিগুলো বাংলাদেশের দুটি অফশোর ব্লক থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নিয়েছে বলে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য হিন্দু বিজনেস লাইন সংবাদ প্রকাশ করেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পেট্রোবাংলার পরিচালক (অর্থ) একেএম মিজানুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ভারতীয় কোম্পানি দুটির ব্যাংক গ্যারান্টি প্রত্যাহার হয় চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে। এটা অনেকদিন আগেই হয়েছে। মার্চে কোম্পানি দুটির অনুসন্ধান কার্যক্রমের মেয়াদ শেষ হয়। তার আগে ওরা সময়সীমা বাড়ানোর জন্য পেট্রোবাংলাকে জানিয়েছিল। কিন্তু চুক্তির মেয়াদ আর পেট্রোবাংলা থেকে সম্প্রসারণ করা হয়নি।’
অয়েল ইন্ডিয়া গত ১২ আগস্ট বম্বে স্টক এক্সচেঞ্জে (বিএসই) তাদের আর্থিক প্রতিবেদন দাখিল করে জানায়, তারা বাংলাদেশে দুটি ব্লক (এসএস-০৪ এবং এসএস-০৯) থেকে সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সে অনুযায়ী কূপ, অন্যান্য সম্পদ এবং অসম্পূর্ণ কাজের জন্য ৩০৭ দশমিক ৪৩ কোটি রুপি তারা প্রভিশন দেখিয়েছে। মূলত ব্যাংক ঋণের বিপরীতে সম্ভাব্য ক্ষতি মোকাবেলায় ব্যাংকগুলোকে নির্ধারিত পরিমাণ অর্থ সংরক্ষণ করতে হয়, এটিকে প্রভিশন বলা হয়।
আলাদাভাবে ওএনজিসিও গত মঙ্গলবার বিএসই-তে তাদের প্রতিবেদন দাখিল করে বলেছে, সাবসিডিয়ারি সংস্থা ওভিএলের ক্ষেত্রে ২০২৫ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি পেট্রোবাংলা বাংলাদেশের যথাক্রমে ব্লক এসএস-০৪ এবং ব্লক এসএস-০৯-এর জন্য ১৬ দশমিক ৪ মিলিয়ন ডলার এবং ১৬ দশমিক ৭ মিলিয়ন ডলারের ব্যাংক গ্যারান্টি (বিজি) প্রত্যাহার করেছে। ২০২৫ সালের ২৭ জুন ওভিএলের বোর্ড ব্লক এসএস-০৪ এবং এসএস০৯-এর জন্য উৎপাদন অংশীদারি চুক্তি (পিএসসি) বাতিলের অনুমোদন দিয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যেহেতু পেট্রোবাংলা ব্লকের ন্যূনতম কাজের বাধ্যবাধকতা (এমডব্লিউও) পূরণে ব্যর্থ হওয়ায় ব্যাংক গ্যারান্টিগুলো প্রত্যাহার করেছে, এ কারণে ওভিএল তাদের ২০২৬ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকের প্রতিবেদনে ব্লক এসএস-০৪ এবং ব্লক এসএস-০৯-এর জন্য যথাক্রমে ১৪০ কোটি রুপি (১৬ দশমিক ৪০ মিলিয়ন ডলার) এবং ১৪৩ কোটি রুপি (১৬ দশমিক ৭০ মিলিয়ন ডলার) লাভ-ক্ষতির বিবরণীতে অন্তর্ভুক্ত করেছে।
তাদের ২০২৪ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদনে ওএনজিসি বলেছে, এসএস-০৪ এবং এসএস-০৯ ব্লকে বাণিজ্যিকভাবে উত্তোলনযোগ্য জ্বালানি আবিষ্কারের কোনো নিশ্চয়তা না থাকায় অনুসন্ধান সময়ের জন্য প্রায় ৩১ কোটি রুপি (আগের বছর প্রায় ২৯ কোটি টাকা) লোকসান হিসেবে ধরা হয়েছে।
অয়েল ইন্ডিয়া তাদের ২০২৪ বার্ষিক প্রতিবেদনে বলেছে, ২০১২ সালে বাংলাদেশ অগভীর সমুদ্রের ব্লক এসএস-০৪ এবং এসএস-০৯-এ তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের দায়িত্ব দিয়েছিল। ব্লক দুটির মোট আয়তন ১৪ হাজার ২৯৫ বর্গকিলোমিটার। এর মধ্যে এসএস-০৪ ব্লকের আয়তন ৭ হাজার ২৬৯ বর্গকিলোমিটার এবং এসএস-০৯ ব্লকের আয়তন ৭ হাজার ২৬ বর্গকিলোমিটার। উভয় ব্লকের উৎপাদন অংশীদারি চুক্তি (পিএসসি) ২০১৪ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় পাঁচ বছরের প্রাথমিক অনুসন্ধান সময়ের জন্য স্বাক্ষরিত হয়। এতে আরো বলা হয়, দুটি ব্লকেরই মেয়াদ ২০২৫ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত।
অয়েল আরো বলেছে, ব্লকগুলোতে বাধ্যতামূলক সিসমিক জরিপ সম্পন্ন হয়েছে। এসএস-০৪ ব্লকে ১টি (এক) অনশোর কূপ কাঞ্চন-১ এক্স-এর খননকাজ শেষ হয়েছে। দুটি অফশোর কূপ (এসএস-০৪ এবং এসএস-০৯ ব্লকে একটি করে) খননের জন্য চুক্তি কৌশল চূড়ান্ত করা হচ্ছিল। ২০২৪ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত দুটি ব্লকেই কোম্পানির শেয়ারের বিনিয়োগ ছিল ৩১ দশমিক ৮৩ মিলিয়ন ডলার।
পতিত শেখ হাসিনা সরকারের সময় ভারতীয় রাষ্ট্রায়ত্ত ওভিএল, ওআইএল এবং বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রোডাকশন কোম্পানি (বাপেক্স) দুটি ব্লকে তেল ও গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য একটি কনসোর্টিয়াম গঠন করেছিল। এতে ভারতীয় কোম্পানি দুটির প্রত্যেকের ৪৫ শতাংশ করে শেয়ার ছিল এবং বাপেক্সের ছিল বাকি ১০ শতাংশ।
গত বছর ছাত্র-জনতার বিক্ষোভের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে টানাপড়েন শুরু হয়। এরপর থেকে অব্যাহতভাবে চলতে থাকে কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্কের টানাপড়েন। এ পরিস্থিতির মধ্যে ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান কোম্পানির ব্যাংক গ্যারান্টি প্রত্যাহারের ঘটনা ঘটল।
বাংলাদেশের অগভীর সমুদ্রে ৪ ও ৯ নম্বর ব্লকে গ্যাস অনুসন্ধানে ২০১৪ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি পেট্রোবাংলার সঙ্গে চুক্তি করে ভারতীয় তেল-গ্যাস অনুসন্ধানকারী প্রতিষ্ঠানটি। সেই সময় যৌথ অংশীদারত্বে ছিল ভারতের অয়েল ইন্ডিয়া কোম্পানি লিমিটেড (ওআইএল) ও বাংলাদেশে রাষ্ট্রায়ত্ত তেল-গ্যাস অনুসন্ধানকারী প্রতিষ্ঠান বাপেক্স।
বাংলাদেশে সাগরে গ্যাস অনুসন্ধানে ২০১৪ সালে ভারতীয় প্রতিষ্ঠান ওএনজিসি ও ওআইএল চুক্তিবদ্ধ হলেও মূলত তারা সাগর ব্লকে কূপ খননে রিগ বসানোর কার্যক্রম শুরু করে ২০১৯ সালে। ২০২০ সালের শুরুতে খনন কার্যক্রমে যেতে চাইলেও কভিড-১৯ মহামারীর কারণে তা বিলম্বিত হয়। সর্বশেষ ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরের শেষ নাগাদ কক্সবাজারের মহেশখালীর অদূরে ৪ নম্বর ব্লকে খনন কার্যক্রম শুরু করে। দীর্ঘ সময় সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে ভারতীয় কোম্পানি দুটি কাজ করলেও আশাব্যঞ্জক কোনো খবর দিতে পারেনি কোম্পানিটি।