গত ৬ আগস্ট, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এক নির্বাহী আদেশে ভারতের অধিকাংশ রপ্তানি পণ্যের ওপর শুল্ক দ্বিগুণ করে ৫০ শতাংশে উন্নীত করেন। চলতি মাসের শেষদিকে কার্যকর হতে যাওয়া এই সিদ্ধান্তের পেছনে যুক্তি হিসেবে দেখানো হয়েছে, ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বিপুল বাণিজ্য ঘাটতি, এবং নয়াদিল্লির মূল্যছাড়ে রাশিয়ার অপরিশোধিত তেল কেনা অব্যাহত রাখার বিষয়টি।
এই ঘটনা গত কয়েক দশকের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র-ভারত বাণিজ্য সম্পর্কে সবচেয়ে তীব্র অবনতি নির্দেশ করছে। শুল্ক বাড়ানোর প্রতিবাদে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এই পদক্ষেপকে “অন্যায্য ও অগ্রহণযোগ্য” বলে অভিহিত করেন। তার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, রাশিয়ার অপরিশোধিত তেলের অন্য ক্রেতা দেশের বিরুদ্ধে একই ধরনের ব্যবস্থা নেয়নি যুক্তরাষ্ট্র।
“আমরা আমাদের কৃষক ও অভ্যন্তরীণ স্বার্থকে রক্ষা করব, এমনকি যদি তার জন্য ভারী মূল্যও দিতে হয়,” গুজরাটের এক সমাবেশে বলেন মোদি।
বিশ্বের শীর্ষ অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্রের সাথে এই দ্বন্দ্বে ভারত কেন তাড়াহুড়ো করে পিছু হটছে না, তা বোঝার জন্য নতুন ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় চোখ রাখা প্রয়োজন। যেখানে শক্তির ভারসাম্যেই আমূল পরিবর্তন আসছে।
প্রথমত, মিশর, ইথিওপিয়া, ইরান, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ইন্দোনেশিয়া যুক্ত হয়ে নতুন সম্প্রসারণের ফলে ব্রিকস এখন একটি ৩২.৫ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনৈতিক জোটে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে এ জোট বিশ্বের ৩০-৪০ শতাংশ জিডিপি এবং বিশ্ববাণিজ্যের এক-পঞ্চমাংশ নিয়ন্ত্রণ করছে। ব্রিকস যদিও এখনো উন্নত অর্থনীতিগুলোর জি-৭ জোটের বিকল্প নয়, তবে নিঃসন্দেহে একটি বাস্তবসম্মত পাল্টা মেরুকরণ তৈরি করেছে।
দ্বিতীয়ত, মার্কিন ডলার এখনও বিশ্বের প্রধান রিজার্ভ মুদ্রা হলেও– এর প্রভাব কমছে। ২০০০ সালে যেখানে বৈশ্বিক রিজার্ভ ও আন্তর্জাতিক লেনদেনে ডলারের অংশীদারিত্ব ছিল ৭২ শতাংশ, তা এখন নেমে এসেছে প্রায় ৫৮ শতাংশে। ভারত-রাশিয়ার প্রায় ৬৫-৬৯ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্যর বড় অংশ এখন রুপি ও রুবলে নিষ্পত্তি হচ্ছে। সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ আরও কয়েকটি দেশের সঙ্গে অনুরূপ মুদ্রাবিনিময় ব্যবস্থা নীরবে গড়ে তুলছে ভারত।
তৃতীয়ত, বৈশ্বিক সাপ্লাই চেইনে ভারতের ভূমিকা তাকে কিছুটা কৌশলগত ক্ষমতা দিয়েছে। বিশ্বের ৬০ শতাংশ জেনেরিক ওষুধ ভারত তৈরি করে, এবং ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ২৮ বিলিয়ন ডলারের ফার্মাসিউটিক্যালস পণ্য রপ্তানি করেছে। একইভাবে, ভারতের আইটি ও আইসিটি সেবার রপ্তানি বছরে প্রায় ১৫০ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে, যা সিলিকন ভ্যালি থেকে ওয়ালস্ট্রিট পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের কর্পোরেট ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত। ফলে ভারতের পণ্যের ওপর শুল্ক চাপানো শেষ পর্যন্ত মার্কিন ভোক্তা ও কোম্পানির জন্যই বিপরীতে গিয়ে দাঁড়াতে পারে।
মোদির জন্য প্রকৃত সুবিধা নিহিত আছে কূটনৈতিক “মাল্টি-অ্যালাইনমেন্ট” বা “অপশনালিটি”তে, যেখানে ভারত কোনো এক মেরুর ওপর নির্ভর না করে বহু অংশীদারের সঙ্গে সমান্তরাল সম্পর্ক গড়ে তুলছে।
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস. জয়শঙ্কর একে ব্যাখ্যা করেছেন “আবেগ নয়, বরং স্বার্থের ভিত্তিতে অংশীদার বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা” হিসেবে।
৩.৪ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি ও ১.৪ বিলিয়ন জনসংখ্যার বাজার ভারতকে দিয়েছে বাড়তি সামর্থ্য; আর ব্রিকস, কোয়াড, সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন (এসসিও) এবং জি২০-তে সক্রিয় উপস্থিতি দিয়েছে সক্ষমতার পরিধি। একদিকে পশ্চিমা নিরাপত্তা কাঠামোর মধ্যে এক পা রেখে, অন্যদিকে রাশিয়া, ইরান, উপসাগরীয় অঞ্চল ও মধ্য এশিয়ার সঙ্গে গভীর সম্পর্ক বজায় রাখা—এই বিশেষ অবস্থান ভারতকে দিয়েছে অসাধারণ কৌশলগত নমনীয়তা।
এটি আর্থিক ক্ষেত্রেও প্রতিফলিত হচ্ছে। যত বেশি ভারত স্থানীয় মুদ্রায় বাণিজ্য নিষ্পত্তি করবে, তত কম হবে যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক চাপের প্রভাব। শুল্ক বা নিষেধাজ্ঞার মতো অস্ত্র তখন অনেকটাই ভোঁতা হয়ে যাবে।
ওয়াশিংটনের ধারণা, শুল্ক বাড়িয়ে ভারতকে কৌশলগত অনুগত্যে বাধ্য করা যাবে। কিন্তু ইতিহাস বলে, টানা শুল্কযুদ্ধ সাধারণত বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খলকে নতুন পথে চালিত করে। এখানে প্রথম সংকেতও তেমনই ইঙ্গিত দিচ্ছে।
ভারতকে বিচ্ছিন্ন করার পরিবর্তে এই শুল্ক হয়তো ত্বরান্বিত করবে বহুমেরু বিশ্বের উদ্ভবকে—যেখানে বাণিজ্য সরাসরি ব্রিকস, উপসাগরীয় অঞ্চল ও আসিয়ান বাজারে প্রবাহিত হতে পারে। বিকল্প পেমেন্ট সিস্টেম ও মানদণ্ডও আরও শক্তিশালী হবে। যদিও এই সম্ভাবনা চটজলদি বাস্তবে রূপ নেওয়াটা কঠিন। তবে শুরুটা হতেই পারে।
রাজনৈতিকভাবে, যুক্তরাষ্ট্রের এই চাপ প্রয়োগ মোদির কাছে অভ্যন্তরীণভাবে “সার্বভৌম প্রতিরোধ” প্রদর্শনের একটি সুযোগ হয়ে দাঁড়াতে পারে, বিশেষ করে আসন্ন আঞ্চলিক নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে।
যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ক্ষতিও উপেক্ষা করা যাবে না। ভারতীয় ওষুধের দাম বাড়লে মার্কিন স্বাস্থ্যখাতে চাপ পড়বে, আইটি সেবার বিঘ্নে কর্পোরেট কার্যক্রমে জট তৈরি হবে। শ্রমবাজারে ইতোমধ্যে সংকটময় পরিস্থিতিতে, প্রতি বছর পাঁচ লাখ নতুন প্রকৌশলী তৈরি করা দেশটিকে দূরে ঠেলে দেওয়া যুক্তরাষ্ট্রের জন্যও ক্ষতিকর পদক্ষেপ হতে পারে।
এভাবে দেখলে, ট্রাম্পের শুল্ক বৃদ্ধি কেবল এক “স্ট্র্যাটেজিক ওন গোল” হয়ে উঠতে পারে। দুই দশক ধরে যে রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট সরকারগুলোর দ্বিদলীয় প্রচেষ্টায় ভারতকে চীনের পাল্টা ভারসাম্য হিসেবে গড়ে তোলার কৌশল চালানো হচ্ছিল, তা এখানে ধাক্কা খাবে। কোয়াডের মাধ্যমে ইন্দো-প্যাসিফিকে সামুদ্রিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার মুহূর্তে প্রতিরক্ষা সহযোগিতায় অনিশ্চয়তাও তৈরি করবে।
সবচেয়ে বড় কথা, এটি বার্তা দিচ্ছে যে, যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক কূটনীতি ক্রমেই “জিরো-সাম” বা শূন্য-যোগফলে পরিণত হচ্ছে। এতে অন্য অনেক ‘সুইং স্টেট’ও বিকল্প মেরু খুঁজে নেবে। সম্ভাবনা আছে ব্রিকস জোটের সদস্যরাসহ ও আরও কিছু মধ্যম শক্তির দেশও পরাশক্তির চাপ থেকে নিজেদের বাঁচাতে একই পথে হাঁটবে।
যদি ট্রাম্পের লক্ষ্য সত্যিই ভারতকে ঘনিষ্ঠ রাখা হয়, তবে আরও সূক্ষ্ম কূটনৈতিক মিশ্রণ প্রয়োজন—যেখানে চাপ থাকবে, কিন্তু তার সঙ্গে প্রণোদনাও থাকবে।
সেক্ষেত্রে নয়াদিল্লির সঙ্গে অচল বাণিজ্য আলোচনাকে পুনরুজ্জীবিত করা, সেমিকন্ডাক্টর ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মতো খাতে যৌথ বিনিয়োগ, কৃষি ও সেবা খাতে বাজারে প্রবেশের প্রতিবন্ধকতা দূর করার মতো পদক্ষেপ হতে পারত কার্যকর কৌশল।
তাতে রাশিয়া নিয়ে শক্ত আলোচনা হতো বটে, কিন্তু ভারতের বিকল্প মেরুতে ঝুঁকে পড়া ঠেকানো যেত। অন্যদিকে, পশ্চিমা চাপ যত বাড়বে, নয়াদিল্লি তত বেশি করে ব্রিকস ও অ-পশ্চিমা জোটগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করবে, যেখানে বহুমেরুকরণের বিশ্বব্যবস্থায় কৌশলগত স্বায়ত্তশাসনের নিশ্চয়তা রয়েছে।