বিশ শতকের সেরা দশ স্থপতির একজন লুই আই কান, তার শ্রেষ্ঠ কাজ বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ ভবনের নকশা। শুধু সংসদ ভবনই নয়, সংসদ ভবনের চারপাশের এলাকাও গড়ে উঠেছে তার নকশা অনুযায়ী।
এটি পৃথিবীর বৃহত্তম আইনসভা ভবনগুলোর একটি, যা ২১০ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত। এর স্থাপত্য নান্দনিকতা বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত এবং অনেক স্থপতি এটিকে ২০ শতকের অন্যতম সেরা স্থাপত্যকর্ম হিসেবে বিবেচনা করেন।
দৃষ্টিনন্দন এই সংসদ ভবন দেখার প্রতি মানুষের আকর্ষণ রয়েছে, পাশাপাশি এর চারপাশের অবকাঠামো ও পরিবেশের সৌন্দর্যও উপভোগ করতে চায় সর্বসাধারণ।
নির্মাণের পর সংসদ ভবনের সামনের চত্বর অর্থাৎ দক্ষিণ প্লাজা ও চারপাশ সাধারণের জন্য উন্মুক্ত ছিল। সেখানে জনসাধারণ নির্বিঘ্নে ঘুরে বেড়াতে পারতো। বর্তমানে সংসদ ভবন চত্বর সাধারণের জন্য উন্মুক্ত নেই, দীর্ঘদিন আগে জনসাধারণের প্রবেশ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন সময় নিরাপত্তার কথা বলে সংসদ ভবন ও এর চারপাশের চত্বরে জনসাধারণের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তবে সংসদ ভবন চত্বর জনসাধারণের জন্য আবার উন্মুক্ত করে দেওয়া উচিত বলে মনে করেন অনেকেই।
জাতীয় সংসদ সচিবালয় সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দক্ষিণে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ ও উত্তরে ক্রিসেন্ট রোডের মাঝখানে ২০০ একর জায়গা নিয়ে জাতীয় সংসদ ভবন এবং এর চারপাশের অবকাঠামো, বাগান, লেক ও উন্মুক্ত চত্বর। বিশ শতকে বিশ্বের নির্বাচিত ১০০টি স্থাপত্যের মধ্যে একটি ছিল সংসদ ভবন। মার্কিন স্থপতি লুই আই কান ভবনটির নকশা করেছিলেন, তিনি বিংশ শতাব্দীতে বিশ্বের সেরা দশ স্থপতির একজন ছিলেন। অনেক সময় লেগেছে তার এই পুরো পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে। ১৯৬২ সালে শুরু করে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত চলে এর বাস্তবায়ন কাজ। এরমধ্যে ১৯৭৪ সালে লুই আই কান মারা যান। কিন্তু তার আগেই ১৯৭৩ সালে ভবনের ধারণাটি চূড়ান্ত করে দেন তিনি। সংসদ ভবন, সংসদ সদস্যদের আবাসিক ভবন, জনগণের জন্য দক্ষিণ দিকের খোলা অংশ এসবই লুই আই কানের মূল নকশার অংশ।
সংসদের দক্ষিণ প্লাজা বা চত্বরে জনসাধারণের প্রবেশাধিকার উন্মুক্ত ছিল। প্রতিদিনই বিশেষ করে বিকেল বেলায় এই চত্বরে হেঁটে বেড়াতে, সময় কাটাতে আসতো হাজারো মানুষ। বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত নারী-পুরুষ-শিশু, সব শ্রেণি-পেশার মানুষের মিলনমেলা ও বিনোদনকেন্দ্র হয়ে উঠতো সংসদ ভবন চত্বর।
আশির দশক থেকেই নিরাপত্তার প্রশ্নটি সামনে নিয়ে এসেছে নানান সময়ের সরকার পক্ষ। তখন থেকেই সংসদ ভবন চত্বরে জনগণের অবাধ বিচরণ ও প্রবেশাধিকার বন্ধ বা নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি সামনে চলে আসে। আশির দশকে ওআইসি শীর্ষ সম্মেলন আয়োজন করতে গিয়ে তৎকালীন সরকার সংসদ ভবন এলাকাকে বেড়া দিয়ে আটকাতে চেয়েছিল। স্থপতিদের দিক থেকে আপত্তি ওঠায় তখন সেই ধারণা থেকে সরকারকে সরে আসতে হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত ‘গরু-ছাগলের’ প্রবেশ ঠেকাতে কয়েক ফুট উচ্চতার গ্রিল দেওয়া হয়েছিল। তবে সংসদ ভবন চত্বরে সাধারণের প্রবেশাধিকার তখনো ছিল।
বাংলাদেশের সংসদ ভবন বিশ্বের অন্যতম সেরা স্থাপত্য, এক অনন্য শিল্পকর্ম হিসেবে বিবেচিত। সংসদ ভবনটি এদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ হয়ে উঠেছে। বিশ্বের অনেক দেশেই সংসদ ভবন দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত থাকে। ১৯৭৩ সালের জানুয়ারি মাসে লুই আই কান যে চূড়ান্ত নকশাটি অনুমোদন করেছেন, তাতে দেখা দক্ষিণ চত্বরটি পার্কসহ জনগণের জন্য খোলা রাখা হয়েছে। সেই নকশায় সংসদ ভবনের চারপাশে বেড়ার কোনো অস্তিত্ব নেই। মানিক মিয়া এভিনিউয়ের দিকে সীমানাজুড়ে ফোয়ারা ও ছোট খালের কথা বলা আছে।
সংসদ সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, ২০০১ সালে ভারতের নয়াদিল্লিতে ভারতীয় সংসদ ভবনে জঙ্গি সংগঠন ‘লস্কর-ই-তৈয়বা’ ও ‘জৈস-ই-মহম্মদ’-এর সদস্যরা হামলা চালায়। এই হামলায় একজন সাধারণ নাগরিকসহ ১২ জনের মৃত্যু হয়। ভারতের ওই ঘটনার পর বাংলাদেশে জাতীয় সংসদ ভবনের নিরাপত্তায় অধিক গুরুত্ব দেওয়ার কথা চিন্তা-ভাবনা করা হয়। এরপর থেকে সংসদ অধিবেশন চলাকালীন সময়ে সংসদ ভবনের চত্বরে সাধারণের প্রবেশ বন্ধ করা হয়। তবে ২০১৪ সালে সংসদ ভবনের নিরাপত্তা আরও নিশ্চিত করতে সংসদ সচিবালয় থেকে উদ্যোগ নিয়ে সংসদ ভবন চত্বরকে লোহার শিকের ‘খাঁচায় বন্দি’ করা হয়। এর আগে সংসদ চত্বরে জনগণের প্রবেশ সংকুচিত ও নিরাপত্তা চৌকি বসানো হলেও ফুটপাতে হাঁটতে বা দাঁড়িয়ে সংসদ ভবন ও খোলা চত্বর দেখার সুযোগ ছিল। কিন্তু লোহার শিকে ঘিরে ফেলার পর প্রবেশ পুরোপুরি বন্ধ ও লোহার শিকের ফাঁক দিয়ে সংসদ ভবন ও এর চত্বর দেখতে হয়।
সংশ্লিষ্টদের মতে, দেশ পরিচালনা ও গণতন্ত্রের কেন্দ্র হিসেবে দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থাপনা জাতীয় সংসদ। এই সংসদ ভবনে বসেই সংসদ সদস্যরা আইন প্রণয়ন, পরিবর্তন, সংশোধন, পরিমার্জন, যুগোপযোগী করে থাকেন। এখানে অনুমোদিত আইন দিয়ে দেশ পরিচালিত হয়। তাই সংসদ ভবনের নিরাপত্তার দিকটি কোনোভাবেই উপেক্ষা করা যাবে না। বিগত দশকগুলোতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে রাজনৈতিক, সামাজিকসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনেক পরিবর্তন ঘটে গেছে, যার সঙ্গে নিরাপত্তার বিষয়গুলো যুক্ত রয়েছে। এসব পরিবর্তনের ফলে আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তার বিষয়গুলোও নিশ্চিত করতে নতুন নতুন পদক্ষেপ ও কৌশল নিতে হচ্ছে এবং আগের পদক্ষেপ ও কৌশল বদলাতে হচ্ছে বলে সংসদ ভবনের নিরাপত্তা রক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা জানান।
তাদের মতে, যেকোনো দেশ এবং দেশ পরিচালনার দায়িত্বে থাকা সরকারকে অস্থিতিশীল ও অকার্যকর করে ফেলতে বিপথগামী ও সন্ত্রাসী গোষ্ঠী বিভিন্ন ধরনের নাশকতার পথ বেছে নেয়। এসব করতে গিয়ে তারা গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা, প্রতিষ্ঠান ও জায়গাকে টার্গেট করে। বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ ধরনের অনেক ঘটনার অতীত উদাহরণ রয়েছে। এদিক থেকে জাতীয় সংসদ ভবন দেশের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রতিষ্ঠান। ফলে সংসদ ভবনের নিরাপত্তার দিকটি নিয়ে সবসময় সব সরকার গুরুত্ব দিয়ে আসছে।