বাংলাদেশ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ- সিআইডি, একটি রিক্রুটিং এজেন্সির বিরুদ্ধে মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছে, যাদের বিরুদ্ধে ছিল সিন্ডিকেটের মাধ্যমে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে অনিয়মের অভিযোগ। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ মামলায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি বা মানবপাচারের কোনো প্রমাণ মেলেনি।
ফলে সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ওরফে ‘লোটাস কামাল’-এর পরিবারের সদস্য এবং তিন সাবেক আওয়ামী লীগ সাংসদসহ অভিযুক্ত সিন্ডিকেট সদস্যরা মামলাটি থেকে অব্যাহতি পেতে চলেছেন।
তবে তদন্ত প্রতিবেদনের ওপর অনাস্থা জানিয়ে আদালতে ‘নো কনফিডেন্স’ পিটিশন করেছেন বাদী।
গত ১৫ মে মার্কিন গণমাধ্যম ব্লুমবার্গ এক প্রতিবেদনে জানায়, কুয়ালালামপুর প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে ঢাকাকে ‘অপ্রমাণিত অভিযোগ’ বাদ দেওয়ার আহ্বান জানায়, যাতে যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের বার্ষিক মানবপাচার প্রতিবেদনে (ট্রাফিকিং ইন-পারসনস রিপোর্ট) মালয়েশিয়ার অবস্থান উন্নত হয়।
মালয়েশিয়ার সেই চিঠি বিষয়ে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব নেয়ামত উল্যা ভূঁইয়া দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, “আমি এই বিষয়ে কিছু জানি না। যদি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়ে থাকে, আমাদের উপদেষ্টারা বিষয়টি দেখছেন এবং সম্ভবত জবাবও দিয়েছেন।”
মালয়েশিয়ায় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সরকারি সফরের বিষয়ে গতকাল ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন প্রেস সচিব শফিকুল আলম। সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে এই মামলা নিয়ে মালয়েশিয়ার চাপের কারণে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল হয়েছে কিনা— এমন প্রশ্নের জবাবে টিবিএসকে তিনি বলেন, এবিষয়ে তাঁর কোনো তথ্য নেই। তিনি এজন্য প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন।
তবে উপদেষ্টা আসিফ নজরুলের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা ব্যর্থ হয়, কারণ তিনি ফোন কেটে দেন এবং পরবর্তীতে হোয়াটসঅ্যাপ পাঠানো ম্যাসেজেরও সাড়া দেননি।
এদিকে সিআইডির ফিনান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিট ও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) পৃথক তদন্ত চালাচ্ছে। সিন্ডিকেট সদস্যরা সরকারি নির্ধারিত খরচের চেয়ে অনেক বেশি অর্থ নিয়েছেন– এমন প্রমাণ পাওয়ার দাবি করেছে তারা।
খাতসংশ্লিষ্টরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, এই সিন্ডিকেটের কালপ্রিটরা যদি জবাবদিহি ও দুর্নীতির অভিযোগ থেকে রেহাই পায়, তবে একই ধরনের সিন্ডিকেট আবারও গড়ে উঠতে পারে। বিশেষত প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনুসের ১১ থেকে ১৩ আগস্ট— তিনদিনের মালয়েশিয়া সফরের প্রাক্কালে এই শঙ্কা বেড়েছে।
গত বছরের মে মাসে সরকারি নির্ধারিত অভিবাসন খরচের পাঁচ থেকে ছয় গুণ পর্যন্ত আদায়ের অভিযোগ ওঠার পর থেকে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার বাংলাদেশি শ্রমিকদের জন্য বন্ধ রয়েছে। এ শ্রমবাজার পুনরায় খোলার বিষয়টি এবার সফরের আলোচ্যসূচিতে শীর্ষে থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
গত বছরের ৩ সেপ্টেম্বর আফিয়া ওভারসিজের স্বত্বাধিকারী আলতাব খান পল্টন থানায় এই মানবপাচারের মামলা দায়ের করেন, যেখানে ১০৩ জনকে অভিযুক্ত করা হয়। অভিযোগে বলা হয়, একটি সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ২৪ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়েছে।
মামলায় আসামিদের মধ্যে রয়েছেন— সাবেক প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী ইমরান আহমদ, সাবেক সিনিয়র সচিব আহমেদ মুনিরুস সালেহীন, সাবেক এমপি নিজাম উদ্দিন হাজারী, অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী, এবং সাবেক অর্থমন্ত্রী লোটাস কামালের স্ত্রী কাশ্মিরী কামাল ও মেয়ে নাফিসা কামাল। এছাড়া অন্তত ১০০ রিক্রুটিং এজেন্সির মালিকের নাম রয়েছে।
গত অক্টোবরে এ মামলায় সাবেক মন্ত্রী ইমরান আহমদকে গ্রেপ্তার করা হয়।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিসের (বায়রা) সাবেক জয়েন্ট সেক্রেটারি মো. ফখরুল ইসলাম বলেন, “আমরা চাই প্রধান উপদেষ্টার আসন্ন সফরে সিন্ডিকেট মুক্তভাবে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার খুলে যাবে। কিন্তু এটা খুবই উদ্বেগজনক যে সিন্ডিকেটের সাথে জড়িতদের দায়মুক্তি দেয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এটা ভবিষ্যতের জন্য অশনি সংকেত।”
বাদী তার আবেদনে আরও উল্লেখ করেছেন যে, “মামলার তথ্য উপযুক্ত সবকিছু আছে। ইন্টারপোলের চিঠিতে অভিযোগের সত্যতা রয়েছে। আর দেশি-বিদেশি মিডিয়ায় অসংখ্য প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।”
সব প্রয়োজনীয় প্রমাণ ইতিমধ্যেই বিদ্যমান। তিনি বলেন, “ইন্টারপোলের চিঠি এই অভিযোগগুলোর সত্যতা নিশ্চিত করেছে। এ বিষয়ে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে অসংখ্য প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।”
তিনি ইন্টারপোলের ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরো (এনসিবি) ঢাকা কর্তৃক গত ২৪ অক্টোবর তারিখে প্রেরিত একটি চিঠির কথা উল্লেখ করেন, যেখানে মালয়েশিয়ার পুলিশকে সহযোগিতা করার অনুরোধ জানানো হয় দুই অভিযুক্ত হোতাকে গ্রেপ্তারের জন্য—বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মালয়েশিয়ান নাগরিক মো. আমিনুল ইসলাম (আমিন নূর) এবং বায়রার সাবেক মহাসচিব মোহাম্মদ রুহুল আমিন—যাদের বিরুদ্ধে মানবপাচার ও চাঁদাবাজির অভিযোগ রয়েছে।
পল্টন থানায় দায়ের মামলার বরাত দিয়ে চিঠিতে বলা হয়েছে, উভয় আসামিই এই সিন্ডিকেটের মানবপাচার ও চাঁদাবাজি কার্যক্রমে জড়িত। তাদের গ্রেপ্তার ও জিজ্ঞাসাবাদে মামলার মূল ঘটনা উদঘাটিত হবে, যার মধ্যে রয়েছে—আসামিরা কীভাবে প্রতারণার মাধ্যমে ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করেছে, তাদের বিদেশে পাঠিয়েছে এবং শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার করেছে।
চিঠিতে আরও উল্লেখ করা হয় যে, মালয়েশিয়ায় জনশক্তি নিয়োগ প্রক্রিয়া পরিচালিত হয় ফরেন ওয়ার্কার্স সেন্ট্রালাইজড ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (এফডব্লিউসিএমএস)-এর মাধ্যমে, যা বেনটিনেট নামের একটি প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন। বেনটিনেটের শতভাগ শেয়ারধারী হলেন আমিনুল ইসলাম, আর তার মূল সহযোগী রুহুল আমিন।
এনসিবি ঢাকা কার্যালয়ের তথ্যমতে, চলমান তদন্তে নিশ্চিত হওয়া গেছে যে এফডব্লিউসিএমএস-ই এই সংগঠিত মানবপাচার ও অবৈধ অর্থ লেনদেনের মূল প্রক্রিয়া হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। বায়রার সাবেক নেতা মো. ফখরুল ইসলাম বলেন, “এফডব্লিউসিএমএস ছাড়া কোনো শ্রমিককে মালয়েশিয়ায় পাঠানো সম্ভব হয়নি। এই সিস্টেম ব্যবহার করেই তারা পছন্দের এজেন্সিগুলো বেছে নিয়ে সিন্ডিকেট গঠন করে।”
তিনি আরও জানান, আমিনুল ইসলাম ও রুহুল আমিন মালয়েশিয়ার মানবসম্পদ মন্ত্রণালয়ের ওপর ব্যাপক প্রভাব খাটান। ফখরুলের ভাষায়, “তারা এমনকি বাংলাদেশকে চিঠি দিয়ে অনুরোধ করেছে যেন তাদের বা তাদের সিন্ডিকেটভুক্ত এজেন্সিগুলোর বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া না হয়।”
সিআইডির তদন্ত প্রতিবেদন
চূড়ান্ত তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তদন্তকালে মামলার বাদীকে বিস্তারিত জিজ্ঞাসাবাদের পরও তিনি এজাহারে উল্লেখিত অভিযোগের পক্ষে কোনো সাক্ষী বা প্রমাণপত্র উপস্থাপন করতে পারেননি। এমনকি অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আর্থিক লেনদেন বা অতিরিক্ত টাকা নেওয়ারও কোনো দালিলিক প্রমাণ পাওয়া যায়নি। বাদী তার এজেন্সির মাধ্যমে মালয়েশিয়ায় প্রেরিত কর্মীদের থেকে কত টাকা নিয়েছেন তাও স্পষ্ট করেননি।
এজাহারে কর্মী প্রতি অতিরিক্ত টাকা দাবি ও চাঁদা আদায়ের অভিযোগ থাকলেও বাদী সময়, স্থান বা মাধ্যম সংক্রান্ত কোনো নির্দিষ্ট তথ্য দিতে পারেননি এবং কোনো দালিলিক সাক্ষ্যও উপস্থাপন করেননি। এমনকি ২৪ হাজার কোটি টাকা আদায়ের অভিযোগের বিষয়ে কোনো রিক্রুটিং এজেন্সি বা শ্রমিক থেকে অভিযোগ পাওয়া যায়নি।
ফাইনাল রিপোর্টে আরও বলা হয়, আসামিপক্ষের উপস্থাপিত কাগজপত্র অনুযায়ী তারা সরকারের নির্ধারিত ফি — কর্মীপ্রতি ৭৮,৯০০/- টাকা গ্রহণ করেছে, যার বিপরীতে মানি রিসিপ্ট দেওয়া হয়েছে। অতিরিক্ত অর্থ নেওয়ার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
সিআইডি উপসংহারে জানিয়েছে, এজাহারনামীয় আসামিদের বিরুদ্ধে আনীত “অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা, মনগড়া, ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত” উল্লেখ করে মামলা থেকে আসামদের অব্যাহতি দিতে প্রার্থণা করা হয়।
একইসঙ্গে মামলার বাদীর বিরুদ্ধে দণ্ডবিধি ২১১ এবং মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন, ২০১২ এর ১৫ ধারা মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণের আবেদন জানানো হয়।
তদন্ত প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, মালয়েশিয়া সরকার নিজস্ব মানদণ্ড অনুযায়ী বাংলাদেশের ১,৫২০টি বৈধ রিক্রুটিং এজেন্সির তালিকা থেকে ১০০টি এজেন্সি নির্বাচন করে। এখানে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কোনো হস্তক্ষেপ ছিল না। তাই ‘সিন্ডিকেট’ গঠনের অভিযোগ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং ভিত্তিহীন।
তবে পৃথক তদন্তে সিআইডির ফিনান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিট দাবি করেছে, সিন্ডিকেট সদস্যরা প্রতি শ্রমিকের কাছ থেকে দেড় লাখ টাকা নিয়েছে—যা সরকারি হারের প্রায় দ্বিগুণ। এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, “আমরা ১৫ জন ভুক্তভোগীর জবানবন্দি নিয়েছি, যারা ৭৮,৯০০ টাকার বদলে ১.৫ লাখ টাকা দিয়েছেন। আমরা এই মাফিয়া সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে মামলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছি।”
দুদকের মামলা
গত ১১ মার্চ দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে অতিরিক্ত ফি আদায় ও অর্থপাচারের অভিযোগে ১২টি রিক্রুটিং এজেন্সির বিরুদ্ধে ১২টি মামলা করে—যার মধ্যে একটি এজেন্সির মালিক আ হ ম মুস্তফা কামাল।
দুদকের অভিযোগ, এসব এজেন্সি সরকারি নির্ধারিত অভিবাসন খরচের পাঁচ গুণ পর্যন্ত বেশি অর্থ নিয়েছে এবং ৬৭ হাজার ৩৮০ জন শ্রমিকের কাছ থেকে মোট ১ হাজার ১২৮ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে। অভিযোগে বলা হয়, সরকারের নির্ধারিত প্রায় ৭৯ হাজার টাকার পরিবর্তে প্রতি কর্মীর কাছ থেকে তারা সাড়ে ৪ লাখ থেকে ৬ লাখ টাকা পর্যন্ত নিয়েছে। দুদকের সূত্র জানায়, মামলা এখনও চলমান।
২০২১ সালের শেষ দিকে সই হওয়া এক সমঝোতা স্মারকের আওতায়, মালয়েশিয়া ২,৫০০-এর বেশি অনুমোদিত এজেন্সির মধ্যে থেকে মাত্র ১০০টি বাংলাদেশি এজেন্সি বাছাই করে—যা অভিবাসন বিশেষজ্ঞদের মতে, দুই দেশের রাজধানীতে তীব্র লবিংয়ের ফল। তারা বলছেন, এই প্রক্রিয়া সিন্ডিকেটকে নিয়োগে একচেটিয়া প্রভাব বিস্তারের সুযোগ দিয়েছে এবং ফি বাড়ানোর সুযোগ তৈরি করেছে।
চলতি বছরের মে মাসে মালয়েশিয়া দুর্নীতির অভিযোগ তুলে বাংলাদেশি শ্রমিক নিয়োগ কার্যক্রম স্থগিত করে।