জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে যে বৈষম্যহীন বাংলাদেশের প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল, গত এক বছরে তা পূরণে অনেকটাই অসফল অন্তর্বর্তী সরকার। অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজের বদলে বিভক্তি ও বিদ্বেষের সংস্কৃতি দেখা যাচ্ছে।
জুলাই আহতদের পূর্ণাঙ্গ পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে না পারা এবং বিচার বিভাগের প্রকৃত স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে না পারাও চোখে পড়ার মতো। সব মিলিয়ে বৈষম্যহীন বাংলাদেশের স্বপ্নের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছরের পর্যালোচনায় আয়োজিত এক আলোচনাসভায় গতকাল শনিবার (৯ আগস্ট) দেশের বিশিষ্ট নাগরিকরা এসব কথা বলেছেন।
রাজধানীর বিজয়নগরে ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম মিলনায়তনে আয়োজিত ‘অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছর : দায়িত্ব ও ভূমিকা পর্যালোচনা’ শীর্ষক আলোচনা সভাটির আয়োজন করে গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটি।
এতে সভাপ্রধান হিসেবে বক্তব্য দেন গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটির সদস্য অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছরের বিভিন্ন দিক বিশ্লেষণ করেন লেখক ও গবেষক কল্লোল মোস্তফা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মোশাহিদা সুলতানা ঋতু, চলচ্চিত্র নির্মাতা আকরাম খান ও স্থপতি ফারহানা শারমিন ইমু।
অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বৈষম্যহীন বাংলাদেশের একটা প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল। চারটি বৈষম্য—অর্থনৈতিক বৈষম্য, শ্রেণি ও লিঙ্গ বৈষম্য, ধর্মীয় বৈষম্য এবং জাতিগত বৈষম্য।
এ চারটি বৈষম্যের ক্ষেত্রে সরকারের যেদিকে যাওয়ার কথা, বৈষম্য দূর করতে যেসব পদক্ষেপ নেওয়ার কথা, তার উল্টো পদক্ষেপ দেখছি আমরা। …এটা সরাসরি গণ-অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা বা প্রত্যাশার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা। বৈষম্যহীন বাংলাদেশের যে স্বপ্ন ও প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল, সেটাকে পুরোপুরিভাবে উপেক্ষা করা, তার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতার বিবিধ লক্ষণ আমরা দেখতে পাচ্ছি। ’
বিগত সরকারের ১৫ বছরে হওয়া মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতাসীনদের গুরুত্ব দিয়েছে উল্লেখ করে আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘যারা ক্ষমতাবান তাঁদের ব্যাপারে অগ্রগতি হয়েছে। ইউনূস সাহেবের (প্রধান উপদেষ্টা) মামলা খুব দ্রুত প্রত্যাহার হয়েছে, সমাধান হয়েছে।
এ রকম যারা ক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত আছেন, তাদের হয়েছে। সবচেয়ে কম হয়েছে শ্রমিকদের বিষয়ে। শ্রমিকদের বিষয়ে আমি যত দূর জানি, তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা, হয়রানি—এগুলোর সমাধান হয়নি। ’
অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে বিগত সরকারের সময় ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া, জাপানসহ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে হওয়া চুক্তিগুলো প্রকাশ এবং জনস্বার্থবিরোধী চুক্তি বাতিলের দাবি থাকলেও এর উল্টোটা হয়েছে বলে দাবি করেন আনু মুহাম্মদ।
অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছরের সামগ্রিক পর্যালোচনা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে কল্লোল মোস্তফা বলেন, ‘মত প্রকাশে সরকারের দিক থেকে সরাসরি খুব বেশি বাধা দেওয়া না হলেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে আমরা বহিষ্কারের ঘটনা দেখেছি। মব সৃষ্টি করে গণমাধ্যমের ওপর চাপ প্রয়োগ, সংবাদ সরাতে চাপ দেওয়া কিংবা সাংবাদিকদের চাকরিচ্যুত করতে বাধ্য করার মতো ঘটনা ঘটেছে। এসব বন্ধ করতে সরকারের দিক থেকে কোনো শক্ত পদক্ষেপ দেখা যায়নি। ’
তিনি বলেন, ‘সাংবাদিকদের খুন করার ব্যাপারটাও কিন্তু আছে। হামলা করা, হাত-পা ভেঙে দেওয়া—পুলিশের সামনেই এগুলো হচ্ছে। সরকারকে এসব ব্যাপারে, এ ধরনের মব সহিংসতার বিষয়ে খুব একটা শক্ত পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। এ ছাড়া উপদেষ্টা ও এনসিপি (জাতীয় নাগরিক পার্টি) নেতাদের নিয়ে কটূক্তি ও সমালোচনার দায়ে কিছু ক্ষেত্রে মামলা ও চাকরিচ্যুতির ঘটনাও ঘটেছে। ’
আলোচনাসভায় গত এক বছরের সাংস্কৃতিক চালচিত্র বিশ্লেষণ করেন চলচ্চিত্র নির্মাতা আকরাম খান। তিনি বলেন, ‘বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের পর প্রত্যাশা ছিল একটা বৈষম্যহীন ও অন্তর্ভুক্তিমূলক দেশের। কিন্তু এক বছরের মধ্যে দেখা গেল, সাংস্কৃতিক জায়গা থেকে বৃহত্তর ঐক্য তৈরি করার বদলে মানুষকে নানা ভাগে বিভক্ত এবং বিদ্বেষের মধ্যে ফেলে দেওয়াই সরকারের বড় কাজ হয়ে গেল। এ ধরনের সাংস্কৃতিক সংঘাত বা নয়া বয়ান প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে জোরজবরদস্তি, জুলুম শুরু করে দিল। ’
তিনি বলেন, ‘গত এক বছরে অনেক ভাস্কর্য-ম্যুরাল ভাঙা হয়েছে। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড চালানোর ব্যাপারে সংস্কৃতিকর্মীরা একটা ভীতির মধ্যে আছেন। গত এক বছর মব ভায়োলেন্স ও ভীতির সংস্কৃতি দেখা গেছে। এই ভীতির কবলে পড়েছে মহান মুক্তিযুদ্ধও। ভীতির কারণে টেলিভিশন থেকে শুরু করে কোথাও সাহস করে কেউ মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কোনো কাজ করছেন না। একটি গোষ্ঠী বিটিভি এবং শিল্পকলাকে কুক্ষিগত করে রেখেছে, যেখানে সরকারি মদদে প্রোপাগান্ডামূলক কাজ চলছে, কিন্তু স্বাধীন সংস্কৃতির চর্চা হচ্ছে না। ’
জুলাই আহতদের চিকিৎসা নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা তুলে ধরতে গিয়ে স্থপতি ফারহানা শারমিন ইমু বলেন, ‘গত এক বছরে জুলাই আহতরা কখনোই অন্তর্বর্তী সরকারের প্রায়োরিটি লিস্টে (অগ্রাধিকার তালিকায়) আসতে পারেনি। ’ তিনি প্রশ্ন রাখেন, ‘এ দেশের জুলাই আহতদের শতকরা ৯০ ভাগ নিম্নবিত্ত শ্রমজীবী পরিবারের বলেই কি তারা প্রায়োরিটি লিস্টে আসতে পারেনি?’
আলোচনাসভায় অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছরের কিছু সফলতাও তুলে ধরেন আলোচকরা। তাঁরা বলেন, সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে কিছু বিষয়ের উন্নতি হয়েছে। সম্পদপাচার বন্ধ হওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে কিছুটা ইতিবাচক ফল দেখা গেছে। রেমিট্যান্স বা প্রবাস আয়ের উন্নতি হয়েছে। ব্যাংকিং ব্যবস্থায় যে ধস নেমেছিল, কিছু উদ্যোগ নেওয়ায় সেখানেও কিছুটা উন্নতি দেখা গেছে।
আলোচনাসভায় বক্তারা আরো বলেন, পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সমালোচনা করলেও তাদের করা নিবর্তনমূলক আইন বাতিলের আগ্রহ দেখাচ্ছে না অন্তর্বর্তী সরকার। রাষ্ট্রের নাগরিকদের ওপর নজরদারিব্যবস্থা ও তৎপরতা আগের মতোই চলছে। গুম নিয়ে কমিশন হলেও এর চেয়েও অনেক বেশি মানুষ মারা যাওয়া ক্রসফায়ার নিয়ে কোনো কমিশন বা তদন্ত হয়নি। সম্প্রতি ঘোষিত জুলাই ঘোষণাপত্রে ইতিহাস খণ্ডিতভাবে এসেছে বলেও জানান তাঁরা।
আগামী জাতীয় নির্বাচনের বিষয়ে আলোচকরা বলেন, গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে হলে প্রশাসনিক, সাংগঠনিক সংস্কারের পাশাপাশি দায়িত্বসহকারে অন্তর্বর্তী সরকারকে পক্ষপাতহীন হতে হবে এবং সুষ্ঠু সমন্বয় করতে হবে।