ভারতের গুজরাটে অবস্থিত রোদে পোড়া শিল্পাঞ্চল জামনগর। বহু আমেরিকান শেষবার এ নাম শুনেছিলেন গায়িকা রিহানার সুবাদে। ২০২৪ সালের মার্চে এখানে তিনি গান গেয়েছিলেন বিল গেটস, মার্ক জাকারবার্গ, ইভাঙ্কা ট্রাম্পসহ বিশেষ অতিথিদের সামনে, এশিয়ার সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি মুকেশ আম্বানির ছোট ছেলে অনন্ত আম্বানির প্রাক-বিবাহ অনুষ্ঠানে।
জামনগরে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর কিংবা পর্যাপ্ত হোটেল না থাকলেও অতিথিরা এসেছিলেন, কারণ এখানকার বন্দর ও তেল শোধনাগার আম্বানি সাম্রাজ্যের কেন্দ্রবিন্দু এবং তার ১১৫ বিলিয়ন ডলারের সম্পদের মূল উৎস।
এই সপ্তাহে জামনগর নিয়ে আলোচনা উঠেছে অন্য এক প্রেক্ষাপটে ; এখানকার তেলের কিছু অংশ রাশিয়া থেকে আমদানি হয়, যা এখন যুক্তরাষ্ট্র-ভারত সম্পর্কের টানাপোড়েনের কেন্দ্রবিন্দু।
এক সপ্তাহ পর ট্রাম্প আরও কঠোর পদক্ষেপ নেন। তিনি নির্বাহী আদেশে শাস্তির মাত্রা দ্বিগুণ করেন। ট্রাম্প যুক্তি দেন, ভারত সরকার আন্তর্জাতিক তেল বাণিজ্যের মাধ্যমে ভারতীয় কোম্পানিগুলোকে লাভবান হতে দিয়ে রাশিয়ার যুদ্ধ প্রচেষ্টাকে পরোক্ষভাবে সহায়তা করছে।
ট্রাম্প সরাসরি কোনো কোম্পানির নাম নেননি। তবে সব সূত্র গিয়ে মিলে মুকেশ আম্বানি ও তার কোম্পানি রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজে।
গুজরাটের জামনগরে অবস্থিত রিলায়েন্সের প্রধান তেল শোধনাগার—যা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নিজ রাজ্যে। ভারতের বিভিন্ন স্থানে রিলায়েন্সের বিনিয়োগ, বিশেষ করে জামনগরে, মোদি ও অন্যান্য রাজনীতিবিদের সঙ্গে পরামর্শ করেই পরিকল্পিত হয়েছে। জামনগর এলাকা ও এর আশপাশের আরেকটি শোধনাগার মিলিয়ে প্রতিদিন ১৫ লাখ ব্যারেল তেল প্রক্রিয়াজাত হয়, যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ আসে রাশিয়া থেকে।
ভারতে রিলায়েন্স নাম সর্বত্র দৃশ্যমান। মুকেশ আম্বানির বাবা ১৯৬৫ সালে বোম্বে (বর্তমান মুম্বাই) শহরে পলিয়েস্টারের ব্যবসা দিয়ে প্রতিষ্ঠানটি শুরু করেছিলেন। এখন এটি দেশের সবচেয়ে বড় শিল্পগোষ্ঠী, যার প্রভাবশালী অবস্থান রয়েছে জ্বালানি, ডেটা ও মোবাইল নেটওয়ার্ক, খুচরা ব্যবসা, আর্থিক খাতসহ নানা ক্ষেত্রে। তারা এইচবিওর স্ট্রিমিং সেবা চালায়, বিশ্বের অন্যতম দামী ক্রিকেট দল মালিকানা করে, বহু দাতব্য সংস্থা পরিচালনা করে এবং সম্প্রতি দেশের প্রায় সব উচ্চমানের ফ্যাশন ব্র্যান্ড কিনে নিয়েছে।
জামনগরের রিলায়েন্স শোধনাগার জটিলতার দিক থেকে আন্তর্জাতিকভাবে শীর্ষ পর্যায়ে। বিভিন্ন ধরনের অপরিশোধিত তেল প্রক্রিয়াজাত করার ক্ষমতা রয়েছে এখানে—পারস্য উপসাগর, লাতিন আমেরিকা বা যেখানে ভালো দামে পাওয়া যায় সেখান থেকে তেল এনে দ্রুত প্রক্রিয়া করা সম্ভব। রিলায়েন্সের এক মুখপাত্র জানিয়েছেন, গত ২৫ বছরে জামনগর শোধনাগারে ৫০০ ধরনের অপরিশোধিত তেল প্রক্রিয়াজাত হয়েছে।
রিলায়েন্স যে অপরিশোধিত তেল কিনে তার প্রায় ৩০ শতাংশ রাশিয়া থেকে আসে। তবে কোম্পানির মুখপাত্র বলেছেন, “শুধুমাত্র রুশ তেলের ছাড় থেকেই লাভ হচ্ছে—এ ধারণা ভুল।” তিনি জানান, রিলায়েন্স দীর্ঘ দশক ধরে ধারাবাহিকভাবে লাভজনক, যা যুদ্ধকালীন ছাড়ের আগেও এবং পরেও আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের চেয়ে এগিয়ে। ইউরোপে প্রক্রিয়াজাত তেল বিক্রি করে যে আয় হয়, তা মোট উৎপাদনের খুবই সামান্য অংশ।
জামনগরের আরেকটি বড় শোধনাগার হলো নায়ারা এনার্জি, যা রিলায়েন্সের শোধনাগার থেকে কয়েক মাইল দূরে। নায়ারার শোধনাগারও বড় ও আধুনিক, যদিও এর উৎপাদন রিলায়েন্সের এক-তৃতীয়াংশ। ২০১৭ সাল থেকে নায়ারার ৪৯ শতাংশ মালিক রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় তেল কোম্পানি রসনেফট। এর অন্যতম বড় শেয়ারহোল্ডারও একটি রুশ মালিকানাধীন বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান। ফলে রসনেফট সমর্থিত একটি প্রতিষ্ঠান রাশিয়া থেকে তেল কিনে ভারতে প্রক্রিয়াজাত করছে এবং কিছু ক্ষেত্রে তা আবার ইউরোপে বিক্রি করছে। রিলায়েন্সের মতো বৈচিত্র্যময় ব্যবসা না থাকায় নায়ারা মূলত একখাতের ওপর নির্ভরশীল।
ইউক্রেন যুদ্ধের প্রথম বছরেই ভারতের এই বেসরকারি শোধনাগারগুলো সমুদ্রপথে রুশ তেলের সবচেয়ে বড় ক্রেতায় পরিণত হয়। ইউরোপীয় বাজারে প্রবেশাধিকার হারিয়ে রাশিয়া আটকে পড়া তেল যে কেউ নিতে রাজি থাকলে ছাড়ে বিক্রি করছিল। ভারত, চীন ও তুরস্ক সেই সুযোগ নেয়।
গত দুই-তিন বছর ধরে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র এ পরিস্থিতিকে স্বাভাবিকভাবেই মেনে নিয়েছিল। ২০২৪ সালের মে মাসে ওয়াশিংটনে এক সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ভারতের রাষ্ট্রদূত এরিক গারসেত্তি বলেছিলেন, “আমরা চেয়েছিলাম কেউ যেন রুশ তেল কিনে, যাতে দাম স্থিতিশীল থাকে।”
কিন্তু ট্রাম্পের সাম্প্রতিক পদক্ষেপ যেন হঠাৎ করেই এল। ন্যাটস্ট্র্যাট নামের থিঙ্কট্যাংকের প্রধান ও ভারতের সাবেক রুশ রাষ্ট্রদূত পঙ্কজ শরণ মন্তব্য করেন, “যে কারণে এই শাস্তি দেওয়া হলো, তা তো ২০২২ সাল থেকেই সবার চোখের সামনে ঘটছে।” তার মতে, রুশ তেল নিয়ে ট্রাম্পের সাম্প্রতিক মন্তব্য মূল ইস্যু থেকে দৃষ্টি সরানোর কৌশল।
১.৪ বিলিয়ন মানুষের দেশ ভারত বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুতবর্ধনশীল বড় অর্থনীতি হলেও এর তেল মজুত খুবই সীমিত; চাহিদার ৮৫ শতাংশই আমদানি করতে হয়। সাধারণত এই আমদানির বড় অংশ আসে পারস্য উপসাগরীয় দেশগুলো থেকে, যা বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ সৃষ্টি করে এবং বাণিজ্য ঘাটতি বাড়ায়। ফলে তেলের চাহিদা কীভাবে মেটানো হবে, তা নিয়ে সরকারকে সবসময়ই কৌশল নিতে হয়।
“আমাদের কোনো তেল নেই, তাই জ্বালানি খরচের বিরুদ্ধে আমরা পুরোপুরি অসহায়,” বলেন শরণ। “এই কারণেই সরকার শোধনাগার খাতকে সক্রিয়ভাবে উৎসাহ দিয়েছে।”
রিলায়েন্সের আর্থিক অবস্থান এমন যে, রুশ তেলের ব্যবসা ছাড়াও তারা টিকে থাকতে পারে। নায়ারা এনার্জির ক্ষেত্রেও তা সম্ভব হতে পারে, যদিও প্রতিষ্ঠানটি কোনো মন্তব্য করেনি। এমন ইঙ্গিত পাওয়া গেছে যে ইউরোপীয় দেশগুলো যখন আমদানি সীমাবদ্ধতা আরও কঠোর করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তখন ভারতের সব অপরিশোধিত তেল আমদানিকারকই ক্রয় কমাচ্ছিল।
তবে ট্রাম্পের হুমকি মোদি সরকারের জন্য জটিল পরিস্থিতি তৈরি করেছে—সঙ্গে আম্বানির মতো ব্যবসায়ীদের জন্যও। এখন রাশিয়া থেকে সরে আসা মানে হবে আত্মসমর্পণ। এমনকি যদি তা লাভজনকও হয়, তবু ভারতের কোনো নির্বাচিত নেতার পক্ষে এটি গ্রহণযোগ্য নয়।