অনেক বছর পর এবারই প্রথমবারের মতো পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা– বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) নির্দিষ্ট শেয়ার কেনা বা বিক্রি না করার জন্য অংশীজনদের ফোন করছে না। বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর—এটাই সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন।
মার্চেন্ট ব্যাংকার, ব্রোকার এবং অ্যাসেট ম্যানেজাররা বলছেন, গত ১২ মাসে আরও কিছু ইতিবাচক উন্নয়ন ঘটেছে। এর মধ্যে রয়েছে একসময় ব্যাপক আকার ধারণ করা দুর্নীতি, অনিয়ম ও বাজার কারসাজি বন্ধের লক্ষ্যে কাঠামোগত পরিবর্তনের পদক্ষেপ। রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি এবং বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে থাকা সরকারি শেয়ার পুঁজিবাজারে ছাড়ার সরকারি পদক্ষেপকেও স্বাগত জানিয়েছেন তারা।
তবে মানসম্পন্ন শেয়ারের সংকটের মতো একটি সমস্যা রয়েই গেছে। অংশীজনরা বলছেন, বিএসইসি প্রাথমিক গণপ্রস্তাব (আইপিও), মার্জিন ঋণ এবং মিউচ্যুয়াল ফান্ড সংক্রান্ত তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিধিবিধান সংস্কারে ধীর গতিতে কাজ করছে। এই পরিবর্তনগুলোকে নতুন তালিকাভুক্তির জন্য জরুরি বলে মনে করা হয়।
অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট একটি সংস্থার প্রধান নির্বাহীর হিসাবে, বিনিয়োগযোগ্য শেয়ারের সংখ্যা ১০টিরও কম। গত এক বছরে কোনো কোম্পানি আইপিও চালু করেনি। বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন নিয়ন্ত্রক সংস্থা তার তালিকাভুক্তির নিয়মগুলো পর্যালোচনা করছে, যাতে যথেষ্ট সময় লাগে, ফলে অন্তত আরও ছয় মাস কোনো আইপিও আসার আশা করছেন না তারা।
পুঁজিবাজারের পূর্ণ সম্ভাবনা কাজে লাগানো যাচ্ছে না
গত পাঁচ বছর অস্থির এক সময়ের মধ্যে দিয়ে গেছে বাংলাদেশ। প্রথমে ২০২০ সালের করোনা মহামারি, এরপরে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব—যাতে ব্যাহত হয় বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খল, বেড়ে যায় পণ্যের দাম, আর সাম্প্রতিক সময়ের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির অনিশ্চয়তা— এত কিছুর মধ্যেও কিছুটা মন্থির গতিতে হলেও প্রবৃদ্ধির মুখ দেখেছে দেশের অর্থনীতি। তবে সেই প্রবৃদ্ধি দেশের পুঁজিবাজারে প্রতিফলিত হয়নি।
বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল্যায়ন ৪৫০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি, এবং আগামী দুই বছরের মধ্যে এটি অর্ধ লাখ কোটি ডলারে পৌঁছানোর পথে। তবুও ৭ আগস্ট পর্যন্ত ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের বাজার মূল্যায়ন ছিল মাত্র ৫৮.৬৬ বিলিয়ন ডলার, বা জিডিপির প্রায় ১২-১৩ শতাংশ। এর তুলনায়, ভারতে তালিকাভুক্ত স্থানীয় কোম্পানিগুলোর ক্ষেত্রে এই অনুপাত ১৩১ শতাংশ এবং পাকিস্তানে প্রায় ২০ শতাংশ।
বাংলাদেশের বৃহৎ কয়েকটি শিল্পগোষ্ঠী– যেমন মেঘনা গ্রুপ অফ ইন্ডাস্ট্রিজ, আবুল খায়ের গ্রুপ এবং সিটি গ্রুপ – প্রত্যেকেই ডজনখানেক কোম্পানি পরিচালনা করে। তাঁদের বার্ষিক টার্নওভার ৩-৪ বিলিয়ন ডলার। অথচ তাদের কোনো ব্যবসা পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত নয়, কারণ তারা পুঁজিবাজারের মাধ্যমে তহবিল সংগ্রহের চেয়ে উচ্চ সুদের ব্যাংক ঋণ নিতেই পছন্দ করে। ব্যবসায়ীরা বলেছেন, অনুকূল নয় এমন বিধিবিধান এবং শেয়ার মূল্য নির্ধারণের বিরূপ ফর্মুলাসহ বিভিন্ন কারণে তারা বাজারে আসতে চান না।
টাস্কফোর্সের সুপারিশ দীর্ঘমেয়াদে ফল দেবে
গত বছরের আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পুঁজিবাজার সংস্কারের জন্য পাঁচ সদস্যের একটি টাস্কফোর্স গঠন করে বিএসইসি। গত অক্টোবরে গঠিত এই টাস্কফোর্সের জন্য পুঁজিবাজার উন্নয়ন ও সুশাসন নিশ্চিত করতে ১৭টি টার্মস অব রেফারেন্স নির্দিষ্ট করা হয়।
৩০ জুনের মধ্যে টাস্কফোর্স পাঁচটি বিষয়ে প্রতিবেদন দিয়েছে, যেগুলোকে তারা ‘লো-হ্যাঙ্গিং ফ্রুট’ হিসেবে উল্লেখ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে আইপিও, মার্জিন ঋণ, মিউচ্যুয়াল ফান্ড, আইটি বিধিমালা এবং করপোরেট গভর্ন্যান্সের পরিবর্তন। এরমধ্যে তিনটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। তবে সংসদীয় অনুমোদন লাগবে এমন সুপারিশ—যেমন ডি-মিউচ্যুয়ালাইজেশন আইন সংশোধন বা শেয়ার বাইব্যাক আইন প্রণয়ন—এড়িয়ে গেছেন তারা।
বাজারসংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব পরিবর্তনের প্রভাব এখনো দেখা যায়নি। ডিবিএ সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেন, “সুপারিশগুলো কাগজে-কলমেই রয়ে গেছে। প্রকৃতপক্ষে পুঁজিবাজার উন্নয়ন ও বিনিয়োগকারীর আস্থা ফেরাতে তেমন কোনো সংষ্কার হয়নি। দুটি অ্যাসেট ম্যানেজার বিনিয়োগকারীর কোটি কোটি টাকা নিয়ে লাপাত্তা, সে বিষয়ে কোনো উদ্যোগ আছে? নেই, বিনিয়োগকারী কেন পুঁজিবাজারে আসবে?”
তিনি আরও বলেন, “ডি-মিউচ্যুয়ালাইজেন রিভিউ স্টেকহোল্ডারদের বড় দাবি ছিল, কিন্তু এক বছর পার হলেও কমিশন কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। পুঁজিবাজার সংষ্কার করতে চাইলে, এসব বিষয়ের সমাধান করা দরকার।”
সাইফুল মনে করেন,”বাজার উন্নয়নের বড় সুযোগ ছিল এটি, কিন্তু তা কাজে লাগানো যায়নি।”
আইনেই বিনিয়োগের প্রতিবন্ধকতা
উন্নত দেশগুলোতে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগে অনুমতি ও উৎসাহ দেওয়া হয়। কিন্তু বাংলাদেশে আইনই এ ধরনের বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত করে।
ঢাবির সহযোগী অধ্যাপক আল আমিন বলেন, “বিশ্বব্যাপী পেনশন ফান্ড ও বিমা কোম্পানিগুলোকে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগে উৎসাহিত করা হয়, কিন্তু বাংলাদেশ আইন করে ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবসা হিসাবে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। তবে প্রতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ কীভাবে আসবে? যার কারণে প্রতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের ফান্ড ব্যাংকিং চ্যানেলে চলে যাচ্ছে। ব্যাংকখাতই বিনিয়োগের উৎস হয়ে উঠছে। এই অবস্থার পরিবর্তন দরকার।”
বাজার কারসাজির জন্য কোটি কোটি টাকার জরিমানা
বর্তমান কমিশন ২০২১ ও ২০২২ সালে শেয়ার কারসাজির জন্য প্রায় দুই ডজন কোম্পানিকে এক হাজার কোটি টাকার বেশি জরিমানা করেছে।
তবে গত এপ্রিল পর্যন্ত জরিমানা আদায় খুবই নগণ্য হলেও— বাজারে শৃঙ্খলা-ফেরানো ও লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিতে ভালো উদ্যোগ বলে মনে করছেন বাজার-সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, কমিশনের কঠোর অবস্থানের ফলে বাজারে একটা বার্তা দেওয়া চেষ্টা ছিল—কাউকে কারসাজির সুযোগ দেওয়া হবে, যারা কারসাজি করেছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে।
তবে বিশাল অংকের জরিমানার ফলে পুঁজিবাজার ভুগেছে। কারণ কারসাজি গোষ্ঠীর একটি অংশ বাজারে নিষ্ক্রিয় হয়। এছাড়া সরকার পরিবর্তনের পর দেশের অর্থনীতিতে স্থবিরতা ও ট্রেজারি বন্ডের সুদহার বেড়ে যাওয়ায়— পুঁজিবাজারে নতুন তহবিলের সংকট তৈরি হয়। ফলে শেয়ার বিক্রির অব্যাহত চাপে মূল্যসূচক ও বাজার মূলধন ব্যাপকভাবে হ্রাস পায়।
যদিও বিগত একমাস ধরে কিছুটা ইতিবাচক ধারায় ফিরেছে পুঁজিবাজার। সূচকের সঙ্গে বাজার মূলধনও বাড়ছে। গত ৬ আগস্ট থেকে পরপর চারদিন দেশের প্রধান মূল্যসূচক ডিএসইএক্স বৃদ্ধি পায় ৭৮৬ পয়েন্ট।
গত ১৯ আগস্ট সাবেক ব্যাংকার খন্দকার রাশেদ মাকসুদ কমিশনে যোগদানের দিন ডিএসইএক্স-এরমূল্যসূচক ছিল ৫,৭৭৫ পয়েন্ট। গত ২৭ মে ডিএসইএক্স পাঁচ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম বা ৪,৭০০ পয়েন্টের নিচে নেমে আসে। যদিও গত এক মাস ধরে বাজারে কিছুটা ইতিবাচক ধারা ফিরেছে, গত ২৭ জুলাই ডিএসইএক্স বেড়ে দাঁড়ায় ৫,৩৫৪ পয়েন্ট।
বিএসইসির ২১ কর্মকর্তা বরখাস্ত
বাজার কারসাজিকারীরা বিএসইসির কিছু দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তার সঙ্গে যোগসাজশে কাজ করতো– এধরনের গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। সম্প্রতি বিএসইসি কার্যালয়ে অভিযান চালিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), অভিযানকালে দুদকের এনফোর্সমেন্ট টিম বিএসইসি থেকে আইপিও অনুমোদন সংক্রান্ত বিষয়ে কোম্পানির আবেদনের তালিকা, তাদের দাখিল করা প্রসপেক্টাস, নিরীক্ষা রিপোর্ট ও প্রয়োজনীয় অন্যান্য নথি এবং চূড়ান্ত অনুমোদন তালিকা যাচাই করে।
দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই বিএসইসি চেয়ারম্যান মাকসুদ বেশ কিছু শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নিয়েছেন, তবে কমিশনের ভেতর থেকেই এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ এসেছে। উত্তেজনা চরমে ওঠে একজন নির্বাহী পরিচালককে সাময়িক বরখাস্ত করার পর। এর প্রেক্ষিতে বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে বর্তমানের কমিশনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামেন কমিশনের কর্মকর্তারা, যা চেয়্যারম্যানের পদত্যাগের আন্দোলনে রূপ নেয়।
গত মার্চের ওই আন্দোলনে পুরো কমিশনকে দিনভর অবরুদ্ধ করে আন্দোলনকারীরা। পরবর্তীতে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার অভিযোগ ১৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়।
এপ্রিলে বিএসইসির ২১ কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এবিষয়ে এখনো চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। সম্প্রতি ওইসব কর্মকর্তাদের বিষয়ে শুনানি হয়েছে, পরবর্তীতে এবিষয়ে চুড়ান্ত নেবে কমিশন।
কমিশনের চেয়্যারম্যানে পদত্যাগ দাবিতে উত্তাল ছিল মতিঝিল। চেয়ারম্যানের পদত্যাগসহ নানান দাবি-দাওয়া নিয়ে বিনিয়োগকারীরা সমাবেশ, স্মারকলিপি প্রদান ও কফিন মিছিলও করেছে। তবে এসব চাপের মুখেও নতি স্বীকার করেননি বিএসইসি চেয়ারম্যান।