দেশের সরকারি স্বাস্থ্যসেবা খাতে বিভিন্ন স্তরে বর্তমানে কর্মরত জনবল প্রায় ১ লাখ ২২ হাজার। এ খাতে অনেক প্রশাসনিক শীর্ষ পদের বিপরীতে অতিরিক্ত জনবল রয়েছে।
দেশের সরকারি স্বাস্থ্যসেবা খাতে বিভিন্ন স্তরে বর্তমানে কর্মরত জনবল প্রায় ১ লাখ ২২ হাজার। এ খাতে অনেক প্রশাসনিক শীর্ষ পদের বিপরীতে অতিরিক্ত জনবল রয়েছে। বিশেষ করে পরিচালক, অধ্যক্ষ, উপপরিচালক, ডেপুটি সিভিল সার্জনের ক্ষেত্রে অনুমোদিত পদের বিপরীতে অতিরিক্ত পদায়ন করা হয়েছে। অন্যদিকে সরাসরি সেবাদানকারী চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্য সহকারী, মেডিকেল কর্মী ও ল্যাবকর্মীর পদে প্রায় ৫০ হাজার জনবল ঘাটতি রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্বাস্থ্যসেবা খাতে এ বিপুল জনবল সংকটের কারণে চিকিৎসাসেবা ব্যাহত হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে জনসংখ্যার তুলনায় পর্যাপ্ত চিকিৎসক, নার্স ও টেকনিশিয়ান নেই। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী যে পরিমাণ চিকিৎসক-নার্স থাকা প্রয়োজন, সেটিও নেই।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মতে, স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় একজন চিকিৎসকের সঙ্গে তিনজন নার্স ও পাঁচজন টেকনিশিয়ান থাকা উচিত। প্রতি ১০ হাজার মানুষের জন্য ২৩ জন চিকিৎসক প্রয়োজন। সেই হিসাবে প্রতি হাজারে অন্তত দুজন চিকিৎসক প্রয়োজন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রকাশিত হেলথ বুলেটিনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে নিবন্ধিত চিকিৎসকের (২০২৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত) সংখ্যা ১ লাখ ৪১ হাজার ৯৯৯। বাংলাদেশের জনসংখ্যা (১৭ কোটি ১০ লাখ) বিবেচনায় প্রতি হাজার মানুষের জন্য চিকিৎসক রয়েছেন শূন্য দশমিক ৮৩ জন। বাংলাদেশে জনসংখ্যা ও চিকিৎসকের এ অনুপাত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের দেশগুলোর তুলনায় অনেক পিছিয়ে।
চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীর সংকটে বিভিন্ন সরকারি হাসপাতাল ও অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানে সেবা পেতে ভোগান্তিতে পড়ছেন রোগীরা। অন্যদিকে সেবাদানকারীরা অনেক সময় আন্তরিকতা থাকলেও অতিরিক্ত রোগীর চাপে যথাযথ সেবা দিতে পারছেন না। ফলে সামর্থ্যবানরা সরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রবিমুখ হচ্ছেন। বাড়ছে চিকিৎসা নিতে বিদেশগামীর সংখ্যা। অন্যদিকে যাদের সে সামর্থ্য নেই তারা নিত্যদিন ভুক্তভোগী হচ্ছেন। সেবা খাতের জনবল সংকট কমাতে সরকারের দ্রুত প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। পাশাপাশি এ খাতে সংস্কারও জরুরি বলে মনে করেন তারা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সর্বশেষ প্রকাশিত বুলেটিনের (নভেম্বর, ২০২৪) তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, দেশের স্বাস্থ্য খাতে সরাসরি মাঠে সেবাদানকারীর ঘাটতি আছে। অন্যদিকে বেশ কয়েকটি প্রশাসনিক শীর্ষ পদে অতিরিক্ত পদায়ন করা হয়েছে। পরিচালক, অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষ ও সমপর্যায়ের অনুমোদিত পদ রয়েছে ১৩৪টি। অথচ এসব পদে ১৮৯ জনকে পদায়ন করা হয়েছে। পদের চেয়ে অতিরিক্ত ৫৫ জন দায়িত্বে আছেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে উপপরিচালক ও সমপর্যায়ের পদ রয়েছে ১৫৬টি। কিন্তু এ পদে জনবল আছে ৩১৪ জন। এ পদে অতিরিক্ত ১৫৮ জনকে পদায়ন করা হয়েছে। অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক, সিভিল সার্জন ও সমপর্যায়ের অনুমোদিত পদ রয়েছে ২৮০টি। এর বিপরীতে কর্মকর্তা রয়েছেন ৪৮৭ জন। অর্থাৎ অতিরিক্ত কর্মরত রয়েছেন ২০৭ জন। ডেপুটি সিভিল সার্জন, উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার জন্য অনুমোদিত পদ রয়েছে ১ হাজার ১৭০টি। অথচ এ পদে কর্মরত আছেন ৩ হাজার ১৯৯ জন। পদের চেয়ে অতিরিক্ত ২ হাজার ২৯ জনকে পদায়ন করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জনবল কাঠামোর ওপরের দিকে অতিরিক্ত পদায়নে স্বাস্থ্য বিভাগের একদিকে যেমন ব্যয় বাড়ছে, অন্যদিকে এসব কর্মকর্তার অনেকে পদ ধরে রেখে সরকারি সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন। যদিও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, প্রশাসনিক এসব পদে অনুমোদিত পদের তুলনায় দ্বিগুণ কিংবা তিন গুণ কর্মকর্তাকে পদায়নের বিষয়টি নানা কারণে করা হয়। উচ্চতর ডিগ্রি নিতে বিদেশ গমন, চাকরির পাশাপাশি দেশে উচ্চতর ডিগ্রির জন্য অন্য প্রতিষ্ঠানে যুক্ত থাকার কারণে অনেক কর্মকর্তাকে ওএসডি (বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) হিসেবে রাখা হয়। এছাড়া অনেক পদায়ন করা হয়েছে, কিন্তু যেগুলোর প্রকৃতপক্ষে কোনো পদ সৃষ্টি করা হয়নি। এসব কারণে তথ্যে (হেলথ বুলেটিনে) অতিরিক্ত কর্মকর্তার পদায়ন দেখা গেছে। তবে সম্প্রতি বিষয়টি সমন্বয় করা হয়েছে বলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর নিশ্চিত করেছে।
বুলেটিনের পরিসংখ্যান অনুসারে, দেশের স্বাস্থ্য খাতে বিভিন্ন স্তরে সরকারের অনেুমোদিত পদের বিপরীতে ৩৪ শতাংশের বেশি পদ খালি রয়েছে। যার বেশির ভাগই মাঠপর্যায়ে সরাসরি সেবাদানকারীর। প্রথম থেকে নবম গ্রেডের বিভিন্ন পদে ৩৮ হাজার ৪২টি অনুমোদিত পদ রয়েছে। এর মধ্যে ৭ হাজার ৯২৫টি পদ খালি আছে। পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এসব পদের মধ্যে পরিচালক, অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষ ও সমপর্যায়ের অনুমোদিত পদের বিপরীতে অতিরিক্ত জনবল থাকলেও সিনিয়র কনসালট্যান্ট, জুনিয়র কনসালট্যান্ট ও সহকারী সার্জনের অনুমোদিত পদের বিপরীতে খালি আছে ৪ হাজার ৩৬৭টি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, কনসালট্যান্ট ও সহকারী সার্জনের অনেক পদ খালি থাকার কারণে কেন্দ্রীয় ও মাঠ পর্যায়ে চিকিৎসাসেবা প্রদান ও সমন্বয়ে সংকট তৈরি হচ্ছে। এসব পদের বিপরীতে কত দ্রুত জনবল নিয়োগ সম্পন্ন করা যায় তা নিয়ে এরই মধ্যে কাজ শুরু করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
স্বাস্থ্যসেবা খাতের অনুমোদিত নিম্ন স্তরের পদগুলো সবচেয়ে বেশি ফাঁকা রয়েছে। এসব পদ ১১ থেকে ১৬তম গ্রেডের মধ্যে। যেখানে ১৭ ধরনের পদ রয়েছে। এসব পদের মধ্যে আছে সাব-অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার, মাঠকর্মী, স্বাস্থ্য পরিদর্শক, সহকারী স্বাস্থ্য পরিদর্শক, মেডিকেল টেকনোলজিস্ট ক্যাটাগরিতে ফার্মেসি, ডেন্টাল, ল্যাব রেডিওলজি, রেডিওথেরাপি, ফিজিওথেরাপি প্রভৃতি। এসব পদে সরকার অনুমোদিত পদ রয়েছে মোট ৯২ হাজার ২৯৪টি। এর বিপরীতে পদ খালি রয়েছে ৩২ হাজার ৫২৬টি। এছাড়া ১৭ থেকে ২০তম গ্রেডের ২৬ হাজার ৪৯টি পদের মধ্যে খালি রয়েছে ১২ হাজার ৫৮৫টি।
দেশের স্বাস্থ্যসেবা খাতে বিপুল জনবল ঘাটতি নিয়ে জানতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. আবু জাফরের সঙ্গে বণিক বার্তার পক্ষ থেকে একাধিকবার চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
মাঠ পর্যায়ে চিকিৎসকের অনেক পদ খালি থাকায় দেশে চিকিৎসাসেবা ব্যাহত হচ্ছে। এছাড়া জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে বিভিন্ন হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মেডিকেল টেকনোলজিস্টের পদ খালি থাকায় পরিপূর্ণ স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হিমশিম খাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা হাসপাতালের কর্মকর্তারা।
দেশে বিপুলসংখ্যক জনসংখ্যার তুলনায় স্বাস্থ্যসেবা খাতে প্রয়োজনীয় চিকিৎসক নেই। এ খাতে চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে পূর্ণাঙ্গ বা যথোপযুক্ত পরিকল্পনা দরকার বলে মনে করেন স্বাস্থ্যসেবা খাতের সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।