দেশে এবার বোরো মৌসুমে ভালো ফলন হয়েছে। সরকারি গুদামে খাদ্য মজুদ পরিস্থিতিও সন্তোষজনক। তার পরও গত তিন মাস বাজারে চালের দাম ঊর্ধ্বমুখী।
দেশে এবার বোরো মৌসুমে ভালো ফলন হয়েছে। সরকারি গুদামে খাদ্য মজুদ পরিস্থিতিও সন্তোষজনক। তার পরও গত তিন মাস বাজারে চালের দাম ঊর্ধ্বমুখী। এ অবস্থায় বিদেশ থেকে জরুরি ভিত্তিতে চাল আমদানি করতে ক্রয় প্রক্রিয়ার সময় কমিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। সামনে আমনের ফলন ক্ষতিগ্রস্ত হলেও যাতে দেশে চালের ঘাটতি না হয়, সেজন্য আগাম সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে চাল আমদানি করা হচ্ছে বলে দাবি সরকারের। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে কৃষি ও খাদ্যশস্য উৎপাদনের পরিসংখ্যান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এ কারণে উৎপাদন ভালো হলেও অনেক সময় বাজারে এর প্রভাব প্রতিফলিত হয় না। এতে বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারকেও সমস্যায় পড়তে হয়।
দেশে চালের মজুদ নিরাপদ পর্যায়ে রাখতে গত ১৫ জুলাই খাদ্য মন্ত্রণালয়ের খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ কমিটির (এফপিএমসি) সভায় সরকারিভাবে চার লাখ টন চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। এরই ধারাবাহিকতায় এবার আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে ক্রয় প্রক্রিয়ার সময় কমিয়ে এনে জরুরিভাবে চাল আমদানি করতে চাইছে সরকার। এজন্য গতকাল অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত অর্থনৈতিক বিষয়-সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির সভায় রাষ্ট্রীয় জরুরি প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক দরপত্র পদ্ধতি অনুসরণ করে চার লাখ টন চাল কিনতে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা অনুসারে ক্রয় প্রক্রিয়ার সময় কমিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে সাধারণ সময়ে ৪২ দিনের মতো সময় লাগলেও বর্তমানে এটি কমিয়ে ১৫ দিনের মধ্যে সম্পন্ন করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাতের মাধ্যমেও পাঁচ লাখ টন চাল আমদানির অনুমতি দেয়া হয়েছে। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে গত ২৩ জুলাই বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে বেসরকারি খাতের আগ্রহী আমদানিকারকদের ৭ আগস্টের মধ্যে অনলাইনে আবেদন করার সময়সীমা বেঁধে দেয়া হয়েছে।
দেশের মোট ধানের প্রায় ৫৫ শতাংশ বোরো মৌসুমে উৎপাদন হয়। এবারের বোরো মৌসুমে ২ কোটি ২৬ লাখ টন ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল সরকার। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এ বছর বোরোতে রেকর্ড ২ কোটি ১৪ লাখ টন ধান উৎপাদন হয়েছে। যদিও বোরোর উৎপাদনের বিষয়ে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাব এখনো প্রকাশিত হয়নি।
এদিকে বর্তমানে সরকারের কাছেও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে খাদ্যশস্যের মজুদ রয়েছে। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুসারে, ৪ আগস্ট পর্যন্ত খাদ্যশস্যের সরকারি মজুদের পরিমাণ ছিল ২১ লাখ ৪৩ হাজার ১৮৭ টন। এর মধ্যে ১৮ লাখ ৯৯ হাজার ৬২৪ টন চাল ও ১ লাখ ১ হাজার ৫৩০ টন ধান মজুদ রয়েছে।
বোরোর বাম্পার ফলন ও সরকারি মজুদ থাকা সত্ত্বেও চাল আমদানির বিষয়ে জানতে চাইলে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার বণিক বার্তাকে বলেন, ‘প্রতি মাসে পাবলিক ফুড ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেমে তিন লাখ টনের বেশি চালের প্রয়োজন হয়। আমাদের জরুরি মজুদ রাখতে হয় সাড়ে ১৩ লাখ টন। কোনো কারণে সামনে যদি আমন ফসলের উৎপাদন কম হয়, তাহলে তাৎক্ষণিকভাবে সেটি পূরণ করা সম্ভব হবে না। এ কারণে জরুরি মজুদ ঠিক রাখার জন্য চাল আমদানি করা হচ্ছে। সরকারকে সবসময় একটু সাবধানতার সঙ্গে কাজ করতে হয়। গত বছরের সেপ্টেম্বরে ১০ লাখ টন আমনের ঘাটতি হয়েছিল। এবারো যদি এ ধরনের কিছু হয় তাহলে সেটি সামাল দেয়ার জন্য আগে থেকেই সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।’
খাদ্যপণ্যের সরকারি পরিসংখ্যানের বিষয়ে বরাবরই প্রশ্ন রয়েছে—এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে খাদ্য উপদেষ্টা বলেন, ‘আমরা এটি অ্যাড্রেস করার চেষ্টা করছি। এ পরিসংখ্যানটি রাখে বিবিএস। আমরা বিবিএস ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য ব্যবহার করি। খাদ্য মজুদের তথ্য প্রতিদিনই প্রকাশ করা হচ্ছে। আগামী ১৪ তারিখে প্রকিউরমেন্ট বন্ধ হয়ে যাবে। এরপর ডিসেম্বরের আগে কোনো ধান-চাল ঢুকবে না। ফলে ডিসেম্বরের আমন ফসল যদি আকস্মিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সেটার ব্যাকআপ হিসেবে আগাম কিছু ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।’
চলতি বোরো মৌসুমে সরকারের ৩৫ হাজার টন ধান, ১৪ লাখ টন সিদ্ধ চাল এবং ৩৫ হাজার টন আতপ চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত রয়েছে। এক্ষেত্রে প্রতি কেজি ধানের সংগ্রহ মূল্য ৩৬ টাকা ও চালের মূল্য ৪৯ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। গত ১৪ এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া এ সংগ্রহ কর্মসূচি চলবে আগামী ৩১ আগস্ট পর্যন্ত। খাদ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, ৫ আগস্ট পর্যন্ত সাড়ে ১২ লাখ টনের মতো বোরো ধান-চাল সংগ্রহ হয়েছে।’
ট্যারিফ কমিশনের হিসাবে দেশে বছরে চালের চাহিদা ৩ কোটি ৫০ লাখ থেকে ৩ কোটি ৮০ লাখ টন। বন্যাসহ প্রাকৃতিক কারণে চালের উৎপাদন কমে গেলে তখন বিদেশ থেকে আমদানির মাধ্যমে চাহিদা মেটাতে হয়। গত বছর বন্যার কারণে চালের উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হলে বেসরকারি খাতে ১৬ লাখ ৭৫ হাজার টন চাল আমদানির অনুমতি দিয়েছিল খাদ্য মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে এ বছরের এপ্রিল পর্যন্ত আমদানি করা হয়েছে ৫ লাখ ৪০ হাজার টন। পাশাপাশি গত অর্থবছরে সরকার ৬ লাখ ৩৮ হাজার টন চাল আমদানি করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুসারে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে (জুলাই-মে) ৬ হাজার ৪৮২ কোটি টাকার চাল আমদানি হয়েছে।
তবে চালের বাজারে বোরোর বাম্পার ফলন কিংবা সরকারের কাছে পর্যাপ্ত মজুদ থাকার কোনো প্রতিফলন বাজারে দেখা যাচ্ছে না। গত তিন মাস দেশে চালের দাম ঊর্ধ্বমুখী। রাজধানীর কারওয়ান বাজারের পাইকারি চাল ব্যবসায়ী ওয়ালিউল্লাহ সিদ্দিকী বলেন, ‘ঈদের পর থেকে চালের দাম বেড়েছে। মিনিকেট জাতীয় মাঝারি চালের দাম ১২-১৫ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। বর্তমানে এ চালের দাম সবচেয়ে বেশি। এখন ৭৮ থেকে ৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গত সরকারের আমলে যেভাবে সিন্ডিকেট করে চাল মজুদ করে সংকট তৈরি করা হতো, এখনো সেটার পরিবর্তন হয়নি। আওয়ামী লীগের আমলে ধাপে ধাপে দাম বাড়ানো হতো। কিন্তু এবার দেখা গেল কয়েকদিনে দাম নাগালের বাইরে চলে গেল।’
দেশে জনসংখ্যার অনুপাতে বাড়ছে না খাদ্যশস্যের উৎপাদন। কৃষিজমি হ্রাস, উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণের অভাব, কৃষি উপকরণের মূল্যবৃদ্ধি এবং সে অনুপাতে কৃষক আয় করতে না পারাসহ বিভিন্ন প্রভাবক কৃষি উৎপাদনে প্রভাব ফেলছে। আর তাতে গত কয়েক বছরে দেশের কৃষি খাত একপ্রকার অচলায়তনে রূপ নিয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এ পরিস্থিতি চলতে থাকলে বড় ধাক্কা লাগতে পারে দেশের খাদ্য ব্যবস্থাপনায়। যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, সর্বশেষ পাঁচ বছরে আবাদকৃত জমির পরিমাণ কমেছে প্রায় ২ শতাংশ। এভাবে প্রতি বছরই কৃষিজমির পরিমাণ কমছে। এর বিপরীতে পাঁচ বছরে হেক্টরপ্রতি ফলন বেড়েছে কেবল ৪ শতাংশ। আর চাল উৎপাদন মাত্র ২ শতাংশ বেড়েছে।
ভরা মৌসুমে দাম বেড়ে বর্তমানে স্থিতিশীল অবস্থায় রয়েছে কুষ্টিয়া ও নওগাঁর চালের বাজার। কুষ্টিয়ায় গত জানুয়ারিতে প্রথম দফায় চালের দাম বাড়ে। মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে মানভেদে চালের দাম প্রতি কেজিতে ৬-৭ টাকা পর্যন্ত বেড়ে যায়। পরবর্তী মূল্যবৃদ্ধি ঘটে জুন-জুলাইয়ে। এ সময়ে আঠাশ, বাসমতী ও কাজল লতা জাতের চালের দাম বেড়ে দাঁড়ায় ৫৮ টাকায়। মিনিকেটের খুচরা দাম একপর্যায়ে ৮৫-৮৬ টাকা পর্যন্ত উঠে যায়। বাসমতীর দাম পৌঁছায় ৯২ টাকায়।
চালের ভরা মৌসুমেও এমন মূল্যবৃদ্ধিতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সাধারণ ক্রেতারা। অনেকেই অভিযোগ করেন বাজারে চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ না থাকায় ইচ্ছাকৃতভাবে দাম বাড়িয়ে রাখা হচ্ছে। জুলাইয়ের শেষদিকে রাজবাড়ী, ফরিদপুর ও কুষ্টিয়ার কুমারখালী, ভেড়ামারা ও মিরপুর অঞ্চল থেকে নতুন বোরো ধান বাজারে আসতে শুরু করে। ফলে ধীরে ধীরে চালকলগুলো সচল হয় এবং বাজারে সরবরাহ বাড়ে। বর্তমানে মিনিকেট চাল বিক্রি হচ্ছে ৮০-৮২ টাকায়, বাসমতীর দাম নেমে এসেছে ৮৮ টাকায়। কাজল লতা ও আঠাশ চালের দামও কেজিতে ৪ টাকা কমেছে।
তবে ভিন্নমত পোষণ করেছেন কুষ্টিয়া পৌরবাজারের কয়েকজন খুচরা ব্যবসায়ী। তাদের ভাষ্য, চালকল মালিকরা চাল ছাড়ছেন ঠিকই। কিন্তু এর পেছনে মূল কারণ হলো সরকারের বিদেশ থেকে চাল আমদানির সিদ্ধান্ত। সরকারি চাল দেশে এলে বাজারে দরপতনের আশঙ্কায় তারা মজুদ না রেখে দ্রুত বিক্রিতে আগ্রহী হয়েছেন।
কুষ্টিয়া কৃষি বিপণন ও বাজার মনিটরিং কর্মকর্তা সুজাদ হোসেন জানান, চালকল মালিকদের কঠোর নজরদারিতে রাখা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘গুদামে অতিরিক্ত চাল পেলেই জরিমানা করা হচ্ছে। বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরির সুযোগ নেই। এ কারণেই দাম এখন স্থিতিশীল।’ এ কর্মকর্তা আরো জানান, বিদেশ থেকে যদি চাল দেশে এসে পৌঁছায়, তাহলে বাজারে দাম আর বাড়ার আশঙ্কা নেই।
নওগাঁর বৃহত্তর চালের মোকাম শহরের আলুপট্টি আড়ত সূত্রে জানা যায়, পাইকারি পর্যায়ে এ আড়তে বর্তমানে মানভেদে প্রতি কেজি শম্পা কাটারি চাল ৭২ থেকে ৭৮ টাকা, জিরাশাইল ৬৮ থেকে ৭২ টাকা, শুভলতা ৬৫ থেকে ৬৭ টাকা, ব্রি আর-আটাশ ৬০ থেকে ৬২ টাকা, পারিজা ৫৫ থেকে ৫৬ টাকা এবং মোয়াজ্জেম চাল ৬৪ থেকে ৬৬ টাকা দরে কেনাবেচা হচ্ছে। এক মাস ধরে চালের এ বাজারদর স্থিতিশীল রয়েছে।