বহু মাস ধরে প্রস্তুতি শেষে কার্যকর হওয়া এই নতুন শুল্কনীতি আসলে ট্রাম্পের আগের ঘোষণারই পরিণতি। এর আগেও তিনি ‘পাল্টা শুল্ক’ (রেসিপ্রোক্যাল ট্যারিফ) নাম দিয়ে এ ধরনের পরিকল্পনা নিয়েছিলেন, তবে নানা বাধায় তখন তা বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বিভিন্ন দেশের আমদানিকৃত পণ্যের ওপর নতুন করে একদফা শুল্ক বৃদ্ধি করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের বহু বাণিজ্য অংশীদারের ওপর শুল্ক আরোপের ফলে বৈশ্বিক বাণিজ্যে নতুন করে উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, এটি গত একশ বছরে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে সবচেয়ে বড় এক পরিবর্তনের সূচনা হতে পারে।
বহু মাস ধরে প্রস্তুতি শেষে কার্যকর হওয়া এই নতুন শুল্কনীতি আসলে ট্রাম্পের আগের ঘোষণারই পরিণতি। এর আগেও তিনি ‘পাল্টা শুল্ক’ (রেসিপ্রোক্যাল ট্যারিফ) নাম দিয়ে এ ধরনের পরিকল্পনা নিয়েছিলেন, তবে নানা বাধায় তখন তা বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। সেই সময় তিনি একাধিক দেশের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য আলোচনায় বসেন। কয়েকটি চুক্তিও হয়, যার ফলে আরও বেশি হারে শুল্ক আরোপ থেকে বিরত থাকা গিয়েছিল।
ট্রাম্প ও তার অর্থনৈতিক উপদেষ্টারা এর আগেই কার্যকর হওয়া শুল্ক বৃদ্ধিকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন। তাদের দাবি, এতে যুক্তরাষ্ট্রের রাজস্ব আয় বেড়েছে ১০০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। সেই সঙ্গে কিছু অর্থনীতিবিদের আশঙ্কা অনুযায়ী ভয়াবহ মূল্যস্ফীতি বা মন্দার মতো ঘটনা ঘটেনি।
নতুন শুল্কহার কত?
বৃহস্পতিবারের আগে যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় সব দেশের পণ্যের ওপর ন্যূনতম ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপিত ছিল। এখন দেশভেদে এই হার উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে।
ব্রাজিলের পণ্যের ওপর সবচেয়ে বেশি ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। এরপরই আছে লাওস ও মিয়ানমার (৪০ শতাংশ), সুইজারল্যান্ড (৩৯ শতাংশ), ইরাক (৩৫ শতাংশ) এবং সার্বিয়া (৩৫ শতাংশ)।
এ ছাড়া আরও ২১টি দেশের ওপর ১৫ শতাংশের বেশি হারে শুল্ক বসানো হয়েছে। এ তালিকায় রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কিছু রপ্তানিকারক দেশ, যেমন—ভিয়েতনাম (২০ শতাংশ), ভারত (২৫ শতাংশ), তাইওয়ান (২০ শতাংশ) এবং থাইল্যান্ড (১৯ শতাংশ)।
ভারত থেকে আমদানিকৃত পণ্যের ওপর অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ শুল্ক বসিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। বুধবার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প স্বাক্ষরিত এক নির্বাহী আদেশের পর এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়। হোয়াইট হাউস জানিয়েছে, রাশিয়া থেকে তেল কেনায় ভারতকে এই ‘শাস্তিমূলক’ শুল্কের আওতায় আনা হয়েছে। নতুন এই শুল্ক কার্যকর হবে ২৭ আগস্ট থেকে।
হোয়াইট হাউস গত সপ্তাহে একটি তালিকা প্রকাশ করেছে, যেখানে বলা হয়েছে—৩৯টি দেশের পণ্য এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যভুক্ত দেশগুলোর ওপর ১৫ শতাংশ হারে শুল্ক কার্যকর রয়েছে।
কানাডা ও মেক্সিকো ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র যেসব দেশ থেকে পণ্য আমদানি করে, তাদের সবাইকে ন্যূনতম ১০ শতাংশ শুল্ক দিতে হবে। তবে কিছু ক্ষেত্রে বিশেষ ছাড় থাকবে।
যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও মেক্সিকোর মধ্যে স্বাক্ষরিত মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি-র শর্ত পূরণ করলেই কেবল মেক্সিকো ও কানাডার পণ্য শুল্কমুক্ত থাকবে। শর্ত পূরণ না হলে মেক্সিকোর পণ্যের ওপর ২৫ শতাংশ এবং কানাডার পণ্যের ওপর ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হবে। কানাডার ক্ষেত্রে আগের শুল্ক হার ছিল ২৫ শতাংশ, যা এবার বাড়ানো হয়েছে।
বাণিজ্য চুক্তির অগ্রগতি কোথায়?
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ট্রাম্প প্রশাসন যে চুক্তিগুলোর কথা বলছে, সেগুলো চূড়ান্ত চুক্তি নয়—বরং সম্ভাব্য চুক্তির খসড়া মাত্র। এসব চূড়ান্ত হতে মাসের পর মাস এমনকি বছরের পর বছরও লাগতে পারে, যদি আলোচনা ভেঙে না পড়ে।
গত পাঁচ মাসে ট্রাম্প সরকার আটটি বাণিজ্যচুক্তির ঘোষণা দিয়েছে। এর মধ্যে কেবল দুটি—যুক্তরাজ্য ও চীনের সঙ্গে—আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাক্ষরিত হয়েছে। চীনের সঙ্গে চুক্তির ফলে দুই দেশ একে অপরের ওপর আরোপ করা বাড়তি শুল্ক অনেকটাই কমিয়ে আনে। তবে এই চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে ১২ আগস্ট। এর আগে দুই দেশ নতুন ব্যবস্থা না নিলে আবার শুল্ক বেড়ে যেতে পারে।
ট্রাম্প ঘোষিত বেশিরভাগ বাণিজ্যচুক্তিতে দেখা যাচ্ছে, অংশীদার দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রের তেল, গাড়ি, বোয়িংয়ের তৈরি বিমান, প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম ও কৃষিপণ্যের মতো পণ্য বেশি পরিমাণে কিনতে সম্মত হয়েছে। এসব চুক্তির আওতায় আমেরিকান ব্যবসার শত শত বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ প্রতিশ্রুত হয়েছে।
তবে এসব চুক্তির অনেক শর্ত নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও অংশীদার দেশগুলোর মধ্যে সত্যিকার অর্থে পূর্ণ সমঝোতা হয়েছে কি না, তা এখনও পরিষ্কার নয়। যেমন—জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিগেরু ইশিবা এবং দেশটির শীর্ষ বাণিজ্য আলোচক রিওসেই আকাজাওয়া সম্প্রতি জানিয়েছেন, অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এখনো চূড়ান্ত হয়নি। তাদের বক্তব্য ট্রাম্পের দাবির সঙ্গে পুরোপুরি মিলছে না। ট্রাম্প এই সপ্তাহের শুরুতে বলেছিলেন, জাপান নাকি ‘ফোর্ড এফ-১৫০’ মডেলের গাড়ি কিনতে রাজি হয়েছে।
নতুন শুল্ক থেকে কিছু পণ্য কি ছাড় পাচ্ছে?
অনেক পণ্যই এই নতুন শুল্কের আওয়াতামুক্ত রয়েছে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে স্মার্টফোন। নতুন কোনো শুল্কই স্মার্টফোনের ওপর কার্যকর হয়নি।
তাছাড়া যেসব পণ্যের ওপর ট্রাম্প ইতিমধ্যে খাতভিত্তিক শুল্ক আরোপ করেছেন কিংবা যেসব পণ্যের বিষয়ে তদন্ত চলমান রয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে এই নতুন দেশভিত্তিক ‘পারস্পরিক’ শুল্কের সঙ্গে অতিরিক্ত কোনো শুল্ক আরোপ করা হবে না।
এ অবস্থায় উদাহরণ হিসেবে বলা যায় ওষুধ—নির্দিষ্ট কিছু দেশ থেকে এখনও শুল্কমুক্তভাবে এসব পণ্য আমদানি করা যাচ্ছে। তবে ট্রাম্প হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, শিগগিরই এসব পণ্যের ওপরও উচ্চহারে শুল্ক আরোপ করা হতে পারে।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) এ ধরনের ঝুঁকি এড়াতে আগেই উদ্যোগ নিয়েছে। তারা ট্রাম্পের সঙ্গে একটি চুক্তির আওতায় যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হওয়া ওষুধের ওপর ১৫ শতাংশ শুল্ক দিতে রাজি হয়েছে। অন্য যেসব দেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তিতে রয়েছে, তারাও নির্দিষ্ট খাতে তুলনামূলকভাবে স্বল্প হারে শুল্ক সুবিধা পাচ্ছে।
এ ছাড়া কিছু পণ্যের ক্ষেত্রে আংশিক ছাড় দেওয়া হয়েছে। যেসব পণ্য বিদেশে তৈরি হলেও অন্তত ২০ শতাংশ মূল্য যুক্তরাষ্ট্রের উপাদান ও শ্রমের মাধ্যমে তৈরি, সেগুলোর ওপরও আংশিক শুল্ক ছাড় প্রযোজ্য হবে।
শুল্ক কার্যকর হলো কবে থেকে?
প্রযুক্তিগতভাবে এসব শুল্ক ইতোমধ্যেই কার্যকর হয়ে গেছে, তবে কিছু পণ্যের জন্য একটি ব্যতিক্রম প্রযোজ্য।
ট্রাম্প গত সপ্তাহে যে নির্বাহী আদেশে সই করেছেন, তাতে বলা হয়েছে—বৃহস্পতিবার (স্থানীয় সময় রাত ১২টা ১ মিনিটের আগে) যেসব পণ্য জাহাজে করে রওনা দিয়েছে এবং এখনো সমুদ্রপথে যুক্তরাষ্ট্রে আসছে, সেগুলোর ওপর ৫ অক্টোবর পর্যন্ত পুরোনো শুল্ক হারই প্রযোজ্য থাকবে।
এখানেই শেষ নয়
ওষুধ ছাড়া আরও বিভিন্ন খাতে শুল্ক আরোপের হুমকি দিয়েছেন ট্রাম্প। হোয়াইট হাউসের ওভাল অফিসে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, চিপ ও সেমিকন্ডাক্টরের ওপর ১০০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হবে। যদিও তিনি কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা উল্লেখ করেননি।
এদিকে ট্রাম্পের এসব নতুন শুল্কনীতির বৈধতা নিয়েও এখনো আদালতে মামলা চলছে। এসব শুল্ক অবৈধ ঘোষিত হলেও, প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্পের হাতে এখনো বহু ক্ষমতা রয়েছে, যার মাধ্যমে তিনি তার উচ্চ শুল্কনীতির কার্যকারিতা ধরে রাখতে পারেন।