বৈশ্বিক ও স্থানীয় পর্যায়ে শিল্প উৎপাদনের গতিপ্রকৃতি নিয়ে নিয়মিতভাবে শিল্প উৎপাদন সূচক পারচেজিং ম্যানেজার্স ইনডেক্স (পিএমআই) প্রতিবেদন তৈরি ও প্রকাশ করে আসছে বিভিন্ন দেশের সরকারি-বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠান।
বৈশ্বিক ও স্থানীয় পর্যায়ে শিল্প উৎপাদনের গতিপ্রকৃতি নিয়ে নিয়মিতভাবে শিল্প উৎপাদন সূচক পারচেজিং ম্যানেজার্স ইনডেক্স (পিএমআই) প্রতিবেদন তৈরি ও প্রকাশ করে আসছে বিভিন্ন দেশের সরকারি-বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠান। মোট ১০০ পয়েন্টের এ সূচক মান ৫০-এর কম হলে তার অর্থ হলো সূচকে উল্লিখিত সময়ে সংশ্লিষ্ট স্থান বা অঞ্চলে শিল্প উৎপাদন কমেছে। বিপরীত চিত্র দেখা যায় সূচক মান ৫০-এর বেশি হলে। বৈশ্বিক আর্থিক খাতের যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক জায়ান্ট জেপি মরগান চেজ অ্যান্ড কোংয়ের পক্ষ থেকেও বৈশ্বিক শিল্প উৎপাদন নিয়ে প্রতিমাসে এমন সূচক প্রকাশ করা হচ্ছে। এতে দেখা গেছে, জুলাইয়ে বিশ্বব্যাপী কারখানাগুলোয় শিল্প উৎপাদন কমেছে। খবর ফাইবার টু ফ্যাশন।
জেপি মরগানের গ্লোবাল ম্যানুফ্যাকচারিং পিএমআই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জুলাইয়ে বিশ্বব্যাপী উৎপাদন, নতুন ক্রয়াদেশ, রফতানি ও কর্মসংস্থান সব ক্ষেত্রেই পতন ঘটেছে। যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আরোপের পূর্বমুহূর্তে বিশ্বব্যাপী কারখানাগুলোয় আগেভাগে সম্ভাব্য সর্বোচ্চ মাত্রায় উৎপাদনের যে প্রবণতা দেখা গিয়েছিল তা এখন আর নেই। অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি নিয়ে ব্যবসায়ীদের আস্থাও এখন তিন মাসের সর্বনিম্নে নেমে এসেছে। অর্থনীতিবিদদের মতে, শুল্কজনিত খরচ বাড়ার আশঙ্কা এড়াতে আগেই যে উৎপাদন বাড়ানো হয়েছিল, এখন তার প্রভাব শেষ হয়ে বৈশ্বিক উৎপাদন খাতের সামগ্রিক কার্যক্রম আবার স্বাভাবিক প্রবৃদ্ধির নিচে নেমে এসেছে।
জেপি মরগানের বৈশ্বিক উৎপাদন সূচকের তথ্যানুযায়ী, জুলাইয়ে টানা দ্বিতীয় মাসের মতো বৈশ্বিক শিল্পোৎপাদন কমেছে, যদিও পতনের হার ছিল সীমিত। খাতভিত্তিক তথ্যেও একই চিত্র পাওয়া গেছে। ভোক্তা পণ্য, মধ্যবর্তী পণ্য ও বিনিয়োগ পণ্য—সব খাতেই উৎপাদন সামান্য কমেছে। এছাড়া টানা চার মাস ধরে নতুন রফতানি ক্রয়াদেশ কমেছে, যা আন্তর্জাতিক বাজারে দুর্বল চাহিদার ইঙ্গিত দেয়।
জেপি মরগানের বৈশ্বিক অর্থনীতিবিদ মায়া ক্রুক জানিয়েছেন, জুলাইয়ে বৈশ্বিক উৎপাদন পিএমআই ১ দশমিক ৬ পয়েন্ট কমেছে, যা জুনের প্রবৃদ্ধিকে প্রায় শূন্যে নামিয়ে এনেছে।
তিনি বলেন, ‘পিএমআই ৪৯ দশমিক ৭-এ নেমে যাওয়ার অর্থ হলো চলতি বছরের দ্বিতীয়ার্ধে (জুলাই-ডিসেম্বর) বৈশ্বিক উৎপাদন খাত স্থবির হয়ে পড়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আরোপ শুধু ভোগ ও ব্যবসায়িক আস্থা কমাচ্ছে না, বরং আগের মাসগুলোয় শুল্কের আশঙ্কায় অগ্রিম উৎপাদনের যে প্রভাব দেখা গিয়েছিল সেটিও এখন শেষ হয়ে যাচ্ছে।’
কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রেও নেতিবাচক প্রবণতা অব্যাহত রয়েছে। জেপি মরগানের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, টানা ১২ মাস ধরে বৈশ্বিক উৎপাদন খাতে কর্মসংস্থানের সুযোগ কমছে। যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ইউরোপীয় অঞ্চলে ছাঁটাই অব্যাহত থাকলেও ভারত, ব্রাজিল ও জাপানে নতুন কর্মী নিয়োগ বেড়েছে।
প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয়েছে, কাঁচামাল ও প্রস্তুত পণ্যের দাম কিছুটা কমলেও উন্নত অর্থনীতির দেশগুলোয় তা তুলনামূলকভাবে বেশি রয়ে গেছে।
অঞ্চলভিত্তিক তথ্যানুযায়ী, জুলাইয়ে বৈশ্বিক উৎপাদন খাতে প্রবৃদ্ধির দিক থেকে শীর্ষ অবস্থানে ছিল ভারত। এরপর রয়েছে ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ড। তবে জুনে সাময়িক উত্থানের পর চীন ও জাপানে উৎপাদন প্রবৃদ্ধি আবারো কমেছে।
এদিকে ইউরোজোনে টানা পাঁচ মাস ধরে উৎপাদন বেড়েছে। আয়ারল্যান্ড, স্পেন, গ্রিস, নেদারল্যান্ডস, জার্মানি ও অস্ট্রিয়া এ প্রবৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। অন্যদিকে উত্তর আমেরিকায় গতি কিছুটা কমেছে। যুক্তরাষ্ট্রে উৎপাদন সামান্য বেড়েছে, তবে কানাডা ও মেক্সিকোর সংকোচন কিছুটা ধীর হয়েছে।
এশিয়ার মধ্যে উৎপাদন খাতে সবচেয়ে বড় পতনের মুখে পড়েছে তাইওয়ান। এরপর রয়েছে তুরস্ক ও পোল্যান্ড। এসব দেশে চাহিদা কমে যাওয়া ও বৈশ্বিক বাণিজ্যে মন্দার প্রভাব উৎপাদন খাতকে উল্লেখযোগ্যভাবে সংকুচিত করেছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
জেপি মরগানের বৈশ্বিক অর্থনীতিবিদ মায়া ক্রুক বলেন, ‘আগামী দিনের পূর্বাভাসও আশাব্যঞ্জক নয়। জুলাইয়ে উৎপাদন পিএমআইয়ের পতনের পেছনে ভূমিকা রেখেছে মূলত যুক্তরাষ্ট্র ও এশিয়ার বিশেষ করে চীন, জাপান, তাইওয়ান ও কোরিয়ায় উল্লেখযোগ্য হারে উৎপাদন কমে যাওয়া।’
পিএমআই সূচকের পতন বৈশ্বিক অর্থনীতির জন্য একটি সতর্কবার্তা হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা।
তারা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শুল্ক আরোপের প্রভাবের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা হ্রাসের ধারা উৎপাদন খাতে অতিরিক্ত চাপ তৈরি করছে। যদি এ প্রবণতা অব্যাহত থাকে, তবে বছরের বাকি সময় বৈশ্বিক উৎপাদন খাতের পুনরুদ্ধার আরো ধীরগতিতে হতে পারে।