যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মধ্যে দীর্ঘদিনের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ভাঙনের ঝুঁকিতে রয়েছে বলে সতর্ক করেছেন বিশ্লেষকরা। কারণ, রাশিয়া থেকে তেল কেনার কারণে ভারতের ওপর শুল্ক ‘ব্যাপকভাবে’ বাড়ানোর হুমকি দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
বছরের শুরুতে ভারত ছিল ট্রাম্পের বিশেষ মনোযোগ পাওয়া সম্ভাব্য দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম—বিশেষ করে চীনের প্রতিপক্ষ হিসেবে ক্রমবর্ধমান ভূমিকায় ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠতার কারণে।
কিন্তু সেই সম্পর্ক এখন চাপের মুখে পড়েছে। বাণিজ্যসহ নানা ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের টানাপড়েন শুরু হয়েছে। ট্রাম্প অ্যাপলসহ ভারতে উৎপাদনকারী বিভিন্ন কোম্পানিকে হুমকি দিয়েছেন, পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করেছেন এবং ভারতের অর্থনীতিকে ‘মৃত’ বলে বিদ্রুপ করেছেন।
সোমবার ট্রাম্প অভিযোগ করেন, ভারত রাশিয়া থেকে ‘অত্যধিক পরিমাণে’ তেল আমদানি করছে। এর জবাবে তিনি ভারতীয় পণ্যের ওপর মার্কিন শুল্ক ‘ব্যাপকভাবে’ বাড়ানোর ঘোষণা দেন। বর্তমানে এ শুল্কহার ২৫ শতাংশ, যা এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম সর্বোচ্চ। চীনের পাশাপাশি ভারতও এখন রাশিয়ার অপরিশোধিত তেলের অন্যতম শীর্ষ ক্রেতা, যে দেশটিকে ২০২২ সালে ইউক্রেনে হামলার পর পশ্চিমা বিশ্ব নিষেধাজ্ঞার আওতায় এনেছে।
এ বিষয়ে ভারত তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। দেশটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এই সমালোচনা ‘অযৌক্তিক ও অগ্রহণযোগ্য’। ভারতের দাবি, রাশিয়া থেকে তেল কেনার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রই শুরুতে তাদের সমর্থন দিয়েছিল।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে প্রচলিত জ্বালানি সরবরাহ ইউরোপমুখী হয়ে পড়ে। তখন ভারতে আমদানির বিকল্প উৎস হিসেবে রাশিয়ার প্রতি ঝুঁকতে হয়। যুক্তরাষ্ট্র সেই সময় এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছিল, বৈশ্বিক জ্বালানি বাজারে স্থিতিশীলতা বজায় রাখার স্বার্থে।’
হোয়াইট হাউস এ বিষয়ে তাৎক্ষণিকভাবে কোনো মন্তব্য করেনি।
এই টানাপড়েনের ফলে ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও চাপে পড়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। বিরোধী দলগুলো বলছে, মোদি তাঁর ‘প্রিয় বন্ধু’ ট্রাম্পের সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারেননি।
গত সপ্তাহে কংগ্রেস বলেছে, ‘নরেন্দ্র মোদির বন্ধুত্বের মূল্য এখন গোটা দেশকে দিতে হচ্ছে।’
‘আমি চাই না আপনি ভারতে তৈরি করেন’
চিত্রটা ছিল ভিন্ন বছরের শুরুতে। ফেব্রুয়ারিতে ট্রাম্প ক্ষমতায় ফেরার পর মোদি ছিলেন হোয়াইট হাউসে সফরকারী প্রথম বিশ্বনেতাদের একজন। তখন মোদিও ট্রাম্পের সুরে সুর মিলিয়ে বলেছিলেন, ‘আমি চাই ভারত আবার মহান হোক।’
তবে সেই সৌহার্দ্য টিকল না। এরপর থেকেই ট্রাম্প একের পর এক মন্তব্যে ভারতকে আক্রমণ করে চলেছেন—বিশেষ করে চীন থেকে উৎপাদন সরিয়ে আনা মার্কিন কোম্পানির ভারতে বিপুল বিনিয়োগকে ঘিরে।
গবেষণা সংস্থা ক্যানালিসের তথ্য অনুযায়ী, গত প্রান্তিকে যুক্তরাষ্ট্রে আমদানিকৃত স্মার্টফোনের ৪৪ শতাংশই উৎপাদিত হয়েছে ভারতে—যা চীনসহ অন্য যেকোনো দেশের চেয়ে বেশি। এর মধ্যে রয়েছে আইফোন, যেগুলোর বড় অংশ এখন ভারতে উৎপাদন হচ্ছে বলে জানিয়েছেন অ্যাপলের সিইও টিম কুক।
ট্রাম্প বলেন, ‘আমি তাকে (কুক) বলেছি, “আমি চাই না আপনি ভারতে তৈরি করেন।”‘ মে মাসে এক বক্তব্যে তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রেই যেন ফোন উৎপাদন করা হয়, এমন অনুরোধ জানিয়েছেন কুককে—যদিও এতে বেশ কিছু জটিলতা রয়েছে।
ভারতের শত্রুর সঙ্গে ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠতা
এপ্রিল মাসে ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে এক সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ জন নিহত হয়। এরপর ভারত প্রতিবেশী পাকিস্তানে বিমান হামলা চালায়। দীর্ঘদিন ধরেই পাকিস্তানকে সন্ত্রাসীদের আশ্রয়দাতা বলে অভিযুক্ত করে আসছে ভারত। হামলার জেরে দুদেশের মধ্যে চারদিনব্যাপী সংঘর্ষ শুরু হয়, যা একসময় বড় ধরনের যুদ্ধের আশঙ্কা তৈরি করে।
এই সময় ট্রাম্প দাবি করেন, তিনি ব্যক্তিগতভাবে উভয় পক্ষকে অস্ত্রবিরতির আহ্বান জানিয়ে বিরোধ মেটাতে সাহায্য করেছেন। পাকিস্তান এই প্রচেষ্টার প্রশংসা করলেও ভারত তা নাকচ করে দেয়। এমনকি মোদি ও ট্রাম্পের ফোনালাপেও যুক্তরাষ্ট্রের কোনো মধ্যস্থতার কথা ভারত স্বীকার করেনি।
সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ ইনস্টিটিউটের সিনিয়র গবেষক এবং ভারতের অর্থ মন্ত্রণালয়ের সাবেক কর্মকর্তা অমিতেন্দু পালিত বলেন, ‘ভারত ট্রাম্পের দাবির প্রতি কোনো সমর্থন জানায়নি।’
তিনি যোগ করেন, ‘ট্রাম্পের পক্ষে এটি সহজভাবে গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি।’
এর কিছুদিন পর হোয়াইট হাউসে এক নজিরবিহীন বৈঠকে ট্রাম্প পাকিস্তানের সেনাপ্রধানকে স্বাগত জানান। একই সঙ্গে পাকিস্তানের জন্য আমদানি শুল্ক ১৯ শতাংশে নামিয়ে আনা হয় এবং দেশটির খনিজ তেল অনুসন্ধানে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তির ঘোষণা দেওয়া হয়।
রাশিয়ার ওপর চাপ, ভারতের দিকেও নজর
রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশের পর এবার ট্রাম্পের নজর পড়েছে ভারত-মস্কোর সম্পর্কের দিকে।
দীর্ঘদিন ধরে ভারতের ‘অসংযুক্ত পররাষ্ট্রনীতির’ সুবিধা নিয়ে দিল্লি যেমন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করেছে, তেমনি রাশিয়ার সঙ্গেও কৌশলগত অংশীদারিত্ব বজায় রেখেছে। রাশিয়া ভারতের অন্যতম প্রধান জ্বালানি ও অস্ত্র সরবরাহকারী দেশ।
ইউক্রেন যুদ্ধ ঘিরে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার মুখে রাশিয়ার তেল যখন কম দামে বিক্রি হচ্ছিল, তখন ভারত—বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম জ্বালানি ভোক্তা—সেই তেল কিনে নেয়। এতে বিশ্ববাজারে দাম স্থিতিশীল রাখতে সহায়তা হয়েছে—যা যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারাও স্বীকার করেছেন।
ভারতে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত এরিক গারসেটি বলেন, ‘তারা রুশ তেল কিনেছে, কারণ আমরাই চেয়েছিলাম কেউ সেটা কিনুক।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের পরিকল্পনাই ছিল এমন, যাতে জ্বালানির দাম বেড়ে না যায়।’
তবে ট্রাম্পের শাসনে এসে সেই অবস্থানে পরিবর্তন এসেছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। গত সপ্তাহে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ট্রাম্প লিখেছেন, ‘ভারত ও রাশিয়া একত্রে তাদের মৃতপ্রায় অর্থনীতিকে তলানিতে নিয়ে যেতে পারে।’
চীনভিত্তিক গবেষক অমিতেন্দু পালিত বলেন, ‘এখন আমরা এমন এক পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছি, যেখানে রাশিয়া ও তার মিত্রদের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের চাপ ভারতের দিকেও প্রতিফলিত হচ্ছে।’
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর জানান, ট্রাম্পের এসব অবস্থান দিল্লিকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন করবে না, তবে চীনসহ অন্যান্য দেশের সঙ্গে সম্পর্ক আরও দৃঢ় করতে ভারতের আগ্রহ বাড়তে পারে। গত মাসে বেইজিংয়ে দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকে পাঁচ বছর পর সরাসরি ফ্লাইট চালুর বিষয়ে চীন ও ভারত একমত হয়েছে।
চ্যাথাম হাউসের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক জ্যেষ্ঠ গবেষক চিতিজ বাজপেয়ী বলেন, ‘ভারত এখনো যুক্তরাষ্ট্রকে একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত ও প্রযুক্তিগত অংশীদার হিসেবে ধরে রাখতে চায়।’
তিনি যোগ করেন, ‘তবে আমি মনে করি, এটি এক ধরনের সতর্ক সংকেত।’