উড়োজাহাজের অনলাইন টিকিট বুকিংয়ের বাংলাদেশি প্ল্যাটফর্ম ‘ফ্লাইট এক্সপার্ট’ বন্ধ হয়ে গেছে। আচমকা বন্ধ হওয়ায় বিপাকে পড়েছেন দেশের ছোট ও মাঝারি টিকিট বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো। টিকিট বাবদ ফ্লাইট এক্সপার্টকে পরিশোধ করা টাকা ফেরত পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তায় তারা।
গত শনিবার (২ আগস্ট) ফ্লাইট এক্সপার্ট বন্ধ হওয়ায় শতাধিক ছোট-মাঝারি টিকিট বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের শতকোটি টাকা আটকে যায়। এ টাকা ফেরত পেতে দিশেহারা টিকিট বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের মালিকরা। এর মধ্যে অনেকে টাকা ফেরত পেতে ঢাকার মতিঝিল থানায় মামলা করেন। এখন পর্যন্ত এ মামলায় তিনজন কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তবে এ প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) সালমান বিন রশিদ সায়েম কানাডা পালিয়ে গেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
ফ্লাইট এক্সপার্ট দেশি-বিদেশি বিভিন্ন এয়ারলাইনসের টিকিট বুকিং, হোটেল রিজারভেশন (কক্ষ সংরক্ষণ), ট্যুর প্যাকেজ ও ভিসা প্রক্রিয়াকরণের মতো সেবা দিতো। বিশেষ করে কম খরচে সহজে টিকিট বুকিংয়ের সুবিধার কারণে প্ল্যাটফর্মটি জনপ্রিয় ছিল। এ কারণে দেশের ছোট-বড় টিকিট বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো ফ্লাইট এক্সপার্ট থেকে টিকিট কাটতো।
তবে ফ্লাইট এক্সপার্ট অতিরিক্ত কমিশন ছাড়ের অসুস্থ প্রতিযোগিতায় জড়িয়ে পড়েছিল এবং গ্রাহকদের সঙ্গে প্রতারণা করছে বলে আগেই সতর্ক করেছিল ট্রাভেল এজেন্টদের শীর্ষ সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশ (আটাব)। কিন্তু আটাবের এ বার্তা কেউ আমলে নেয়নি। উল্টো সোমবার (৪ আগস্ট) আটাবের কার্যনির্বাহী কমিটি বিলুপ্ত করে প্রশাসক নিয়োগ দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এমন পরিস্থিতিতে দেশ-বিদেশের উড়োজাহাজের টিকিট বিক্রি নিয়ে এক ধরনের অস্থিরতা তৈরি হয়েছে।
ফ্লাইট এক্সপার্ট প্রতিষ্ঠা করা হয় ২০১৬ সালে। পরের বছর অনলাইন ট্রাভেল এজেন্সির (ওটিএ) কার্যক্রম শুরু করে। গত সাত-আট বছর ধরে অনলাইনে ট্রাভেল এজেন্সি হিসেবে ব্যবসা পরিচালনা করছিল। অতিরিক্ত কমিশন ছাড়ের অসুস্থ প্রতিযোগিতায় কয়েকটি অনলাইন ট্রাভেল এজেন্সির মতো তারাও জড়িয়ে পড়ে। প্রতি টিকিটে বাজারমূল্যের চেয়ে তিন থেকে পাঁচ হাজার, ক্ষেত্রবিশেষে আরও বেশি ছাড় দেওয়ার একটি অসুস্থ প্রতিযোগিতায় জড়ায়। গত ২ আগস্ট প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা অংশীদার ও সিইও সালমান বিন রশিদ শাহ সায়েম হঠাৎ করেই অফিস তালাবদ্ধ রেখে এবং ওয়েবসাইট অকার্যকর করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন বলে জানা যায়।
প্রতিষ্ঠানটি বন্ধের খবরে শোরগোল তৈরি হয়। টিকিট বিক্রেতা ছোট প্রতিষ্ঠানগুলো ফ্লাইট এক্সপার্টের মতিঝিলের কার্যালয়ে ভিড় করে। কার্যালয় বন্ধ দেখে অনেকে হা-হুতাশ করেন।
ফ্লাইট এক্সপার্টের সঙ্গে ব্যবসায়িক লেনদেন ছিল এমন ৬৯টি টিকিট বুকিং ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে নিজেদের তথ্য জানিয়েছে। তাদের দেওয়া হিসাব অনুযায়ী, ৬৯ ব্যবসায়ীর ২৭ কোটি ৩৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা ঝুঁকিতে রয়েছে। তবে এর পাশাপাশি অগ্রিম টিকিট কাটার জন্য অনেক এজেন্সি ফ্লাইট এক্সপার্টের ‘ওয়ালেটে’ টাকা জমা রাখতো। সেই টাকা ফেরত পাওয়া নিয়েও ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।
ঢাকার শাহজাদপুরে ট্রাভেল এক্সপার্ট অ্যাভিয়েশন সার্ভিসেসের স্বত্বাধিকারী আলমগীর হোসেন। তিনিও ফ্লাইট এক্সপার্ট থেকে কানাডাসহ বিভিন্ন দেশের প্রায় ১০ লাখ টাকার টিকিট কিনেছেন। ফ্লাইট এক্সপার্ট বন্ধ হওয়ার পর দুটি টিকিট বাতিল হয়ে গেছে। রিফান্ডের টাকাও গেছে আটকে।
এ ঘটনা নিয়ে আলমগীর হোসাইন তার ফেসবুকে লেখেন, ফ্লাইট এক্সপার্ট পালিয়েছে, আর কিছু এজেন্সি এখন সেই সুযোগে গ্রাহকের সঙ্গে প্রতারণা করছে। ফ্লাইট এক্সপার্ট শুধু নিজের আইএটিএ কোড দিয়েই না—সোমা, হাজি, প্রমা, ফ্লাইফারসহ আরও অনেক এজেন্সির টিকিট নিয়েও বিক্রি করেছে। গ্রাহকরা নগদ টাকা দিয়ে বুক করেছেন, কেউ ইএমআই করেছেন, কারও হজ-উমরা ছিল—এটা সবাই জানে। তবুও কিছু এজেন্সি এখন নিজেদের টাকা উদ্ধারের জন্য টিকিট ক্যানসেল করে রিফান্ড নিচ্ছে। বিষয়টি বিমান মন্ত্রণালয়, সিভিল অ্যাভিয়েশনসহ সংশ্লিষ্টদের নজর দিতে হবে।
ফ্লাইট এক্সপার্ট মতিঝিলের সিটি সেন্টার অফিস থেকে পরিচালনা করা হতো। রোববার (৩ আগস্ট) সকালে ফ্লাইট এক্সপার্টের ওয়েবসাইটে ঢুকতে না পেরে অনেক ছোট টিকিট বিক্রেতা তাদের কার্যালয়ে যান। গিয়ে দেখেন কার্যালয়ে তালা। অফিসের ফোন নম্বরও বন্ধ। তখন তারা খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, ফ্লাইট এক্সপার্টের মালিক গ্রাহকের টিকিটের সব টাকা নিয়ে পালিয়ে গেছেন।
এ ঘটনা মুহূর্তের মধ্যে সারাদেশে ছড়িয়ে যায়। যারা ফ্লাইট এক্সপার্ট থেকে টিকিট কিনেছিলেন, তারা মতিঝিল থানার সামনে ভিড় করেন। পরে ঢাকার চকবাজারের সরকার ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলসের স্বত্বাধিকারী মো. বিপুল সরকার বাদী হয়ে মামলা করেন। এ মামলায় ফ্লাইট এক্সপার্টের সিইও সালমান বিন রশিদ শাহ সায়েমসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলা করেন তিনি। পরে ফ্লাইট এক্সপার্টের তিনজন কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
ভুক্তোভোগীরা জানান, ফ্লাইট এক্সপার্ট বন্ধের পর থেকে বিভিন্ন এয়ারলাইন্সে কাটা অনেক টিকিট যাত্রীদের নামের রেকর্ডে (পিএনআর) তারা দেখতে পাচ্ছেন না। তবে এসব প্রতিষ্ঠানের ফোন নম্বর বন্ধ থাকায় কথা বলা সম্ভব হয়নি।
অবশ্য এজেন্সিগুলো যেন টিকিট রিফান্ড করতে না পারে, সে বিষয়ে সোমবার (৪ আগস্ট) মন্ত্রণালয়ে একটি অনুরোধপত্র দিয়েছে অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশের (আটাব) সভাপতি আবদুস সালাম আরেফ। এর কিছুক্ষণ পরেই তাদের কমিটি বাতিল করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। তাদের বিরুদ্ধে অভ্যন্তরীণ অনিয়ম, দুর্নীতি ও অর্থ আত্মসাতের একাধিক অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে এ সিদ্ধান্ত নেয় মন্ত্রণালয়।
যদিও রোববার রাতে ফ্লাইট এক্সপার্টের ঘটনা নিয়ে জরুরি সভা করেছে আটাব। এতে ফ্লাইট এক্সপার্টকে কারণ দর্শানোর নোটিশ, সদস্যপদ বাতিলে ব্যবস্থা গ্রহণ, যাত্রী হয়রানি ও ট্রাভেল এজেন্টদের আর্থিক ক্ষতি কমাতে ফ্লাইট এক্সপার্ট ইস্যু করা টিকিটগুলোর রিফান্ড স্থগিত করার জন্য জরুরিভাবে পদক্ষেপ নিতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানানো এবং অনলাইনে টিকিট বিক্রি পরিচালনায় দ্রুত গাইডলাইন বা বিধিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করার জন্য সরকারকে আহ্বান জানায় আটাব।