গত তিন অর্থবছরজুড়ে ডলারের তীব্র সংকটে ছিল বাংলাদেশ। এ কারণে ব্যবসায়ীরা চাহিদা অনুযায়ী ঋণপত্র (এলসি) খুলতে পারেননি।
গত তিন অর্থবছরজুড়ে ডলারের তীব্র সংকটে ছিল বাংলাদেশ। এ কারণে ব্যবসায়ীরা চাহিদা অনুযায়ী ঋণপত্র (এলসি) খুলতে পারেননি। সংকট কাটিয়ে এ মুহূর্তে চাহিদার চেয়েও দেশে ডলারের জোগান বেশি। কিন্তু বাড়তি এ জোগান অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে কাজে লাগানো যাচ্ছে না। আমদানিনির্ভর বাংলাদেশে এলসি খোলার প্রবণতা ধারাবাহিকভাবে নিম্নমুখী।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, সদ্য শেষ হওয়া ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দেশে আমদানির এলসি খোলা বেড়েছে ১ শতাংশেরও কম। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৬ হাজার ৮৮৯ কোটি ডলার বা ৬৮ দশমিক ৮৯ বিলিয়ন ডলারের এলসি খোলা হয়েছিল। আর গত অর্থবছরে এলসি খেলা হয়েছে ৬৯ দশমিক শূন্য ১ বিলিয়ন ডলারের। অর্থাৎ অর্থনীতির প্রয়োজন, আকার ও জনসংখ্যা বাড়লেও আমদানি প্রায় একই অবস্থায় থেকে গেছে।
অর্থনীতির স্বাভাবিক চাহিদা মেটাতে প্রতি মাসে বাংলাদেশকে ৫ থেকে ৬ বিলিয়ন ডলারে পণ্য আমদানি করতে হয়। গত অর্থবছরের শুরুতে আমদানির যে পরিস্থিতি ছিল, সেটির ধারাবাহিকতা শেষ পর্যন্ত রক্ষা করা যায়নি। অর্থবছরের শেষ মাস তথা জুনে এলসি খোলার পরিমাণ মাত্র ৪ দশমিক ১৪ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে, যা সাড়ে চার বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুনেও ৫ দশমিক ৪৭ বিলিয়ন ডলারের এলসি খোলা হয়েছিল। সে হিসাবে আগের অর্থবছরের তুলনায়ও জুনে ২৪ দশমিক ৪২ শতাংশ কম এলসি খোলা হয়েছে।
অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংক নির্বাহীরা বলছেন, আমদানি কমে যাওয়ার পেছনে বিনিয়োগ খরা, অর্থনৈতিক স্থবিরতা ও ভোগ ব্যয় কমে যাওয়ার প্রভাব রয়েছে। দেশের বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি মাত্র ৬ দশমিক ৪০ শতাংশে নেমে এসেছে। নতুন শিল্প-কারখানা গড়ে না ওঠায় মূলধনি যন্ত্রপাতির আমদানিও আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে। অর্থনীতিকে প্রাণচঞ্চল করতে হলে আমদানি বাড়াতে হবে বলে মনে করছেন তারা।
আমদানির এলসি খোলা এতটা কমে যাওয়া অর্থনীতির জন্য ভালো নয় বলে জানান শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংক পিএলসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোসলেহ উদ্দীন আহমেদ। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘দেশের অর্থনীতিতে এ মুহূর্তে ডলারের চাহিদা কম। কারণ মূলধনি যন্ত্রপাতির আমদানি এক-চতুর্থাংশ কমে গেছে। মূলধনি যন্ত্রপাতির সঙ্গে আমদানির অনেক অনুষঙ্গ যুক্ত। যন্ত্রপাতি আমদানি না হওয়ায় ওইসব পণ্য আমদানিরও প্রয়োজন হচ্ছে না। আবার এ মুহূর্তে দেশে বড় কোনো অবকাঠামো নির্মাণও হচ্ছে না। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল ও খাদ্যপণ্যের দামও নিম্নমুখী। এসব কারণে বাংলাদেশের আমদানি ব্যয় কমে গেছে।’
মোসলেহ উদ্দীন আহমেদ আরো বলেন, ‘গত অর্থবছরে রেমিট্যান্স হিসেবে প্রায় ৭ বিলিয়ন ডলার বেশি এসেছে। দেশ থেকে অর্থ পাচার ও হুন্ডির তৎপরতাও আগের মতো নেই। আবার ব্যাংক খাতে তারল্যের সংকটও আছে। এসব কারণে ডলারের চাহিদা বাড়ছে না। অর্থনীতিকে প্রাণবন্ত করতে হলে আমদানি বাড়াতে হবে। তবে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা না এলে ডলারের চাহিদা কিংবা বিনিয়োগ বাড়ানো বেশ কঠিন।’
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে শিল্পের মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির এলসি খোলা সবচেয়ে কমেছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ২৩৪ কোটি ডলারের মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির এলসি খোলা হলেও গত অর্থবছরে সেটি মাত্র ১৭৫ কোটি ডলারে নেমে আসে। সে হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে শিল্প স্থাপনের প্রধান এ উপকরণ আমদানি কমেছে ২৫ দশমিক ৪১ শতাংশ। এর আগে ২০২২-২৩ অর্থবছরেও মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি প্রায় ২৪ শতাংশ কমেছিল।
এলসি খোলা কমে যাওয়ার দিক থেকে দ্বিতীয় স্থানে ছিল শিল্পের মধ্যবর্তী পণ্য। এ খাতের আমদানির এলসি খোলা কমেছে ৬ দশমিক ২৬ শতাংশ। এছাড়া শিল্পের কাঁচামাল আমদানির এলসিও দশমিক ১৫ শতাংশ কমেছে। অর্থাৎ জিডিপি প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান ও রফতানি আয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত শিল্প খাতের মৌলিক তিনটি উপকরণের (মূলধনি যন্ত্রপাতি, মধ্যবর্তী পণ্য ও কাঁচামাল) আমদানি এলসি খোলার প্রবণতা নিম্নমুখী।
বিশ্ববাজারে গত দেড় বছর জ্বালানি তেল ও এলএনজির দাম কমছে। এর প্রভাবে দেশের জ্বালানি খাতের আমদানি ব্যয় কমেছে। গত অর্থবছরে এ খাতে আমদানির এলসি খোলা কমেছে ৪ দশমিক ৩৩ শতাংশ। তবে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ভোগ্যপণ্য আমদানির এলসি ২ দশমিক ৯০ ও অন্যান্য পণ্যের এলসি ৫ দশমিক ৬৩ শতাংশ বেড়েছে। সব মিলিয়ে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের তুলনায় গত অর্থবছরে আমদানির এলসি খোলা বেড়েছে দশমিক ১৮ শতাংশ। একই সময়ে আমদানির এলসি নিষ্পত্তি ৪ দশমিক ১৮ শতাংশ বেড়েছে।
দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ আমদানি দেখানো হয় ২০২১-২২ অর্থবছরে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ওই অর্থবছরে রেকর্ড ৮৯ দশমিক ১৬ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছে। যদিও ওই সময় আমদানির আড়ালে দেশ থেকে অর্থ পাচার হয়েছে বলে প্রমাণ পেয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরপর ২০২২-২৩ অর্থবছরে আমদানি ১৫ দশমিক ৮১ শতাংশ কমে ৭৫ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। আর ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আমদানি আরো ১১ দশমিক ১১ শতাংশ কমে যায়। নেমে আসে ৬৬ দশমিক ৭২ বিলিয়ন ডলারে।
আমদানি কমলেও গত অর্থবছরে দেশে রেকর্ড ৩০ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স আসে। আর রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) হিসাবে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৪৮ দশমিক ২৮ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রফতানি হয়। অবশ্য এনবিআরের তথ্যানুযায়ী, গত অর্থবছরে প্রকৃত রফতানির পরিমাণ ৪৬ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলার। রেমিট্যান্স ও রফতানি আয় বাড়ায় দেশে ডলারের বিনিময় হার স্থিতিশীল হয়ে এসেছে। এ কারণে বিনিয়ম হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়ার পরও ডলারের দর নিম্নমুখী।
এ মুহূর্তে বাজারে ডলারের জোগান বেশ ভালো বলে জানান পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলী। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘বাজারে এখন ডলারের চাহিদার তুলনায় সরবরাহ বেশি। এ কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজার থেকে ডলার কিনছে। এতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ছে। এ মুহূর্তে চাহিদা না বাড়লেও নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে এটি বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তখন রেমিট্যান্স ও রফতানি আয় প্রবৃদ্ধির ধারায় থাকলে ডলারের সংকট হবে না।’
গত তিন অর্থবছর বাজার স্থিতিশীল রাখতে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরে এসে ডলার বিক্রি না করে উল্টো বাজার থেকে কেনা হচ্ছে। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ বেশি হওয়ার কারণেই বাজার থেকে ডলার কেনা হয়েছে বলে জানান বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘বাজারে ডলারের সরবরাহের তুলনায় চাহিদা কম। এ কারণেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত মাসে ৫০ কোটি ২০ লাখ ডলার কিনেছে। রোববারও কিছু ডলার কেনার কথা ছিল। কিন্তু দর বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা তৈরি হওয়ায় শেষ পর্যন্ত কেনা হয়নি। দেশে খাদ্যের যথেষ্ট মজুদ আছে। বিদেশী যেসব দায়দেনা বকেয়া হয়ে গিয়েছিল, সেগুলোও পরিশোধ করে দেয়া হয়েছে। এ কারণে সহসা ডলারের বড় কোনো চাহিদা তৈরি হবে না। বাড়তি ডলার বাজার থেকে কিনে নেয়ায় নতুন অর্থবছরে রিজার্ভ অনেক সমৃদ্ধ হবে।’ জাতীয় নির্বাচনের পর রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এলে দেশে বিনিয়োগ ও ডলারের চাহিদা বাড়বে বলে মন্তব্য করেন তিনি।