যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশি পণ্যে রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ (পাল্টা শুল্কও) হার কমিয়ে আনায়, দেশের রপ্তানিকারকদের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের বায়ারদের মধ্যেও কিছুটা স্বস্তি ফিরেছে। তাছাড়া শুল্কের নতুন নির্ধারিত হারও— চীন ও ভারতের তুলনায় কম, যা মার্কিন বাজারে বাংলাদেশকে আরও প্রতিযোগী করেছে।
এই ঘটনার ধারাবাহিকতায় বায়ারদের সঙ্গে ক্রয়াদেশ নিয়ে ফের আলোচনা শুরু হচ্ছে। কেউ কেউ আগের স্থগিত ক্রয়াদেশ অব্যাহত রাখার কথাও বলছেন বলে জানান রপ্তানিকারকরা।
গতকাল ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু বলেন, “অনেক রপ্তানিকারক আমাদের জানিয়েছেন, বায়ারদের প্রতিনিধিরা যোগাযোগ শুরু করেছন এবং হোল্ড হওয়া অর্ডার ফিরতে শুরু করেছে।” তবে একইসঙ্গে এতে আত্মপ্রসাদে না ভুগে—প্রতিযোগিতায় নিজেদের সক্ষমতা বাড়ানোর উপর গুরুত্ব দিয়েছেন তিনি।
গত ৩১ জুলাই যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশি পণ্যের উপর শুল্ক হার ৩৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২০ শতাংশ নির্ধারণ করে। মার্কিন শুল্কের নতুন হারে– চীনের ৩০ শতাংশ এবং ভারতের ২৫ শতাংশের তুলনায় বাংলাদেশ এখন ভালো অবস্থানে রয়েছে। ভিয়েতনামের সঙ্গে ২০ শতাংশ হার সমান হলেও—পাকিস্তানের ১৯ শতাংশের চেয়ে একটু বেশি।
বিজিএমইএ বলছে, এই ২০ শতাংশ শুল্ক হারের সঙ্গে বিদ্যমান ১৬.৫ শতাংশ শুল্ক যোগ হয়ে মোট শুল্ক ৩৬.৫ শতাংশে দাঁড়াবে।
ছয় জন রপ্তানিকারকের সঙ্গে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের কথা হয়েছে, যার মধ্যে চার জন্য জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শুল্কের হার ঘোষণা করার পর আমেরিকান বায়াররা যোগাযোগ করতে শুরু করেছেন। এর মধ্যে কোনও কোনও বায়ার তারা আগে যেসব অর্ডার স্থগিত রেখেছিলেন— সেগুলোর কাজ চালিয়ে যেতে বলেছেন।
স্প্যারো গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শোভন ইসলাম বলেন, “আমার প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৫ মিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ ৩ লাখ পিস পোশাকের অর্ডার হোল্ড করে রেখেছিলেন ইউএস বায়াররা ট্যারিফ ইস্যুর কারণে। ট্যারিফ রেট ২০ শতাংশে নামার পর তাদের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ হয়েছে, এবং ওই অর্ডার কন্টিনিউ করার জন্য বলেছেন।”
স্প্যারো গ্রুপ প্রতিবছর প্রায় ৩০ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করে, যার মধ্যে ১৬ কোটি ডলারের পণ্য যায় ১৭টি মার্কিন ক্রেতা প্রতিষ্ঠান বা বায়ারদের কাছে।
তিনি বলেন, “আমার শীর্ষস্থানীয় ১২ বায়ার নতুন শুল্ক হার নিজেরাই বহন করছে, আমাদের ওপর চাপিয়ে দেননি। নতুন করে যেসব অর্ডার কন্টিনিউ করতে বলেছেন, ওই বাড়তি ট্যারিফের চাপও আমাদের ওপর দেননি। এই প্রেশার তারা নিজেরা নিয়েছেন। তবে আগামী ৫ আগস্টের মধ্যে যেসব পণ্য চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছানো সম্ভব হবে, অতিরিক্ত কস্ট-শেয়ারিং ছাড়াই তা আগের ট্যারিফ রেটের আওতায় থাকবে। এজন্য আমরা পণ্য ৫ আগস্টের মধ্যে পণ্য বন্দরে পৌঁছানোর চেষ্টা করছি”– বলেন তিনি।
অন্য রপ্তানিকারকরাও একই ধরনের ইতিবাচক অগ্রগতির কথা জানিয়েছেন। ঢাকাভিত্তিক মার্কিন বাইয়িং হাউজ– লিয়াং ফ্যাশন লিমিটেড জানায়, তাদের ক্লায়েন্ট সাউথপোল শুল্কহার কমানোর ঠিক সেই দিনেই ৭৬,৬০০ পিস লং প্যান্ট ও শর্টসের একটি অর্ডার চূড়ান্ত করেছে। খুব শিগগিরই একই ধরনের আরও একটি অর্ডার আসার সম্ভাবনাও রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে আরেক শীর্ষ রপ্তানিকারক স্নোটেক্স গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এস এম খালেদ বলেন, “ট্যারিফ ইস্যুর কারণে আমাদের বড় আকারের একটি অর্ডার হোল্ড ছিল। আশা করছি, আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে ওই অর্ডার কনফার্ম হবে।”
“এখনো বায়ারদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক যোগাযোগ হয়নি। তবে প্রতিযোগী অন্য দেশে অর্ডারটি চলে যাওয়ার যে ভয় তৈরি হয়েছিল, তা কেটে গেছে। কেননা তাদের তুলনায় আমাদের ট্যারিফ প্রায় সমান” – উল্লেখ করে তিনি বলেন, “এখন দেখার বিষয় তারা ক্রয়াদেশ কতটুকু দেয়। কেননা ট্যারিফের কারণে পণ্যের দাম বাড়বে। ফলে তাদের চাহিদা কমতে পারে।”
তবে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বছরে প্রায় ৮ কোটি ডলারের এই রপ্তানিকারক জোর দিয়ে বলেন, “দাম কমানোর চাপ সত্ত্বেও—আমরা প্রাইস কমানো কিংবা ডিসকাউন্ট দেব না।”
দেশটির বাজারে বর্তমানে তার মোট রপ্তানির ২০ শতাংশ হলেও—তা অচিরেই ২৭ শতাংশ হবে বলেও আশার কথা জানান তিনি।
বিদেশী বায়ারদের পক্ষ হয়ে বাংলাদেশি রপ্তানিকারকদের সঙ্গে কাজ করা প্রতিনিধিদের সংগঠন– বায়ার্স কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট কাজী ইফতেকার হোসেন মনে করেন, নতুন শুল্ক হারের কারণে বাংলাদেশ থেকে প্রতিযোগী দেশগুলোয় কিছু অর্ডার চলে যাওয়ার যে আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল, তা আর হবে না।
তিনি বলেন, “আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে হোল্ড হওয়া অর্ডার নিয়ে নতুন করে নেগোসিয়েশন হবে। তখন বোঝা যাবে, বায়াররা কীভাবে এই বাড়তি ট্যারিফের প্রেশার সামলাতে চায়।”
বিজিএমইএর সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ট্যারিফ সংক্রান্ত নির্বাহী আদেশে বলা আছে, কোনো পোশাক উৎপাদনে যদি নূন্যতম ২০ শতাংশ আমেরিকার কাঁচামাল (যেমন আমেরিকার তুলা) ব্যবহার করা হয়, তাহলে এসব কাঁচামালের মূল্যের উপর এই অতিরিক্ত ২০ শতাংশ শুল্ক প্রযোজ্য হবে না। অর্থাৎ আমেরিকার কাঁচামাল ব্যবহার করলে বাড়তি শুল্ক ছাড় পাওয়া যাবে।
প্রসঙ্গত, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের রপ্তানি করা পোশাকের ৭৫ শতাংশই কটনের বা তুলার সুতা থেকে তৈরি। ফলে এটি বাস্তবায়ন হলে তা বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক হবে।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে তুলা আমদানি বাড়াতে বাংলাদেশের আমদানিকারকরা ইতোমধ্যে কিছু কার্যক্রম শুরু করছেন। বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে বছরে ৪০০ কোটি ডলারের বেশি তুলার প্রয়োজন হয়, যার মধ্যে মাত্র ৩০ কোটি ডলারের তুলা যুক্তরাষ্ট্র থেকে। এই আমদানি বাড়িয়ে ১ বিলিয়ন ডলার করার পরিকল্পনা রয়েছে সংগঠনটির।
মার্কিন বাজারে বছরে প্রায় ৮৪০ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ, যার মধ্যে প্রায় ৭০০ কোটি ডলার পোশাক পণ্য। এতসব ইতিবাচকতার মধ্যেও ২০ শতাংশ শুল্ক হার প্রয়োগের কিছু শর্ত নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে। বিশেষ করে, ৪০ শতাংশ মূল্য সংযোজনের শর্ত থাকলে কিছু পণ্যে সমস্যা হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন রপ্তানিকারকরা।
বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু বলেছেন, মূল্য সংযোজনসহ অন্যান্য শর্ত এখনো জানা নেই। একই কথা বলেছেন আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিশেষজ্ঞ মোস্তফা আবিদ খান। তাঁর মতে, ‘এসব শর্ত জানার আগে এখনই কোন কনক্লুশনে আসার সুযোগ নেই।’
রপ্তানিকারকরা বলছেন, বাড়তি ২০ শতাংশ শুল্ক ভারের একটি অংশ এখানকার তাদের ওপর আসার আশঙ্কাও রয়েছে। এমন অবস্থায় প্রতিযোগিতার সক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে বন্দর, কাস্টমসের দক্ষতা, লজিস্টিকস সক্ষমতা এবং উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর উপর গুরুত্ব দিয়েছেন বিজিএমইএ সভাপতি।
তিনি বলেন, “আমরা একান্তভাবে আশা করি, শিল্প ও দেশের স্বার্থে সরকারের সকল নীতি সহায়তা চলমান থাকবে, এনবিআর-সহ সংশ্লিষ্ট সকল দপ্তরের দক্ষতা বৃদ্ধি, বিশেষ করে কাস্টমস সংক্রান্ত নীতিগুলো শিল্পবান্ধব করা, চট্রগ্রাম বন্দরের দক্ষতা বৃদ্ধি এবং শিল্পে নিরবিচ্ছিন্নভাবে বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহ রাখার ওপর গুরুত্ব দেন তিনি।”