বাংলাদেশি পণ্যে শুল্ক কমিয়ে ২০ শতাংশ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু মার্কিন পণ্য আমদানিতে ব্যাপক শুল্কছাড় স্থানীয় শিল্পের জন্য আশীর্বাদ না অভিশাপ তা নিয়ে শঙ্কা বাড়ছে। কম শুল্কে আমদানি পণ্য ঢুকলে চাপ বাড়বে স্থানীয় উৎপাদনে। এতে আমদানি প্রতিস্থাপক শিল্পের উদ্যোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন। একটি গণমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এসব নিয়ে কথা বলেছেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান।
তিনি বলেন, এটা তাৎপর্যপূর্ণ স্বস্তি। আগে আমাদের রপ্তানি পণ্যে ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক বসত, এখন সেটা ২০ শতাংশ হওয়ায় আমাদের নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী যেমন ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া ও পাকিস্তানের সমপর্যায়ে চলে এসেছে। ফলে একটি ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ তৈরি হয়েছে, যদিও এটিকে স্থায়ী সমাধান বলা যাবে না। সবাইকেই কিছু না কিছু ছাড় দিতে হয়েছে। যেমন— ২৫টি বোয়িং কেনা, বড় আকারে গম ও তুলা, সয়াবিন, এলএনজি আমদানি করা—এগুলো সবই কূটনৈতিক সমঝোতার অংশ। তবে এই ছাড়েরও মূল্য আছে, তা আমাদের বুঝে নিতে হবে।আসলেই অনেক কিছু অজানা থেকে যাচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যাদের বৈরিতার সম্পর্ক আছে, তাদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক কী হবে, সেটা আমরা জানি না। আমরা জানি না চীন বা ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক বা অন্যান্য প্রতিশ্রুতি কী দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে অন্যান্য দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে এর অভিঘাত আছে। এ জন্য এগুলো স্পষ্টতার প্রয়োজন আছে। এসবের সঙ্গে ভূ-রাজনৈতিক, ভূ-অর্থনৈতিক উন্নয়ন কৌশলের সঙ্গে এগুলো সরাসরি জড়িত। আমরা যেগুলো ছাড় দিয়েছি সেগুলোর অনেকটাই কিন্তু বাস্তবায়ন করতে হবে পরবর্তী নির্বাচিত সরকারকে। তাই এখানে স্পষ্টতার ব্যাপার আছে। কয়েক বছর ধরে এগুলো বাস্তবায়িত করতে হবে। তাই স্বচ্ছতা ও রাজনৈতিক ঐকমত্য জরুরি।যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দর-কষাকষি করে আমাদের ১৫ শতাংশের ওপর আরো ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ মেনে নিতে হলো। বিভিন্ন দেশের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে তা নির্ধারিত হচ্ছে। এগুলোর বিরুদ্ধেই কিন্তু বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা গড়ে উঠেছিল। এখন অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করা বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার রীতিনীতির লঙ্ঘন। এই সংস্থা ভেঙে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। রুল বেইসড বাণিজ্য পরিচালনার ক্ষেত্রে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার ভূমিকাকে ধ্বংস করার বা দুর্বল করার পদক্ষেপ হলো ট্রাম্প শুল্ক। এই ধরনের সংরক্ষণবাদী পদক্ষেপের মাধ্যমে বিশ্ববাণিজ্য প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হচ্ছে। সেটার কারণে কেবল মার্কিন বাজারেই নয়, বৈশ্বিক বাজারেই চাহিদার সংকোচন হতে পারে। এতে যুক্তরাষ্ট্রকেও ভুগতে হবে। চীন বাদ দিলে আমাদের প্রতিযোগী সবাই এখন প্রায় একই পর্যায়ে। তবে শুধু শুল্ক নয়, পণ্যের মূল্য, উৎপাদন খরচ ও দক্ষতা—এই সবই প্রতিযোগিতার ভিত্তি। আমাদের যদি দাম বেশি হয়, তাহলে একই শুল্কেও পিছিয়ে পড়ব। চীনের শুল্ক এখনো চূড়ান্তভাবে নির্ধারিত হয়নি। তাদের বিদ্যমান ২০ শতাংশের ওপর আরো ৬০ শতাংশ বাড়ানো হয়, তাহলে আমরা সুবিধা পাব। প্রধান উপকারভোগী হবে পোশাক খাত। তবে কৃষিপণ্য, চামড়া ও হোম টেক্সটাইলও লাভবান হতে পারে। তবে যেসব খাতে এখনো শুল্ক ছাড় হয়নি বা অ-শুল্ক বাধা রয়েছে, তারা ঝুঁকিতে আছে। আর তুলা-গম বেশি দামে আমদানি হলে স্থানীয় শিল্প খরচে চাপে পড়বে। আমদানি প্রতিস্থাপক দেশীয় শিল্প বাড়তি প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হবে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি বাড়ানো ও তাদের আমদানি শুল্ক হ্রাসের ফলে সমজাতীয় পণ্যের উৎপাদন শিল্পে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। আমরা এখনো জানি না, কত বিস্তৃতভাবে যুক্তরাষ্ট্র থেকে পণ্য আমদানিতে শুল্ক কমানো হয়েছে। আবার শূন্য শুল্ক কিংবা নামমাত্র শুল্ক নির্ধারণ করা হলে রাজস্বে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার নীতি অনুযায়ী, এই সুবিধা অন্যান্য দেশকেও দেওয়ার কথা।এটা পুরোপুরি উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বোয়িং কেনা, গম ও তুলা আমদানি সবই যুক্তরাষ্ট্রকে সুবিধা দিয়েছে। কিন্তু বিমান সংস্থা নিজেরাই বলছে, তাদের ২৫টি বিমান কেনার পরিকল্পনা ছিল না। তাহলে প্রশ্ন আসে—এই চুক্তির অর্থনৈতিক যৌক্তিকতা কী? এখন ৫০ হাজার কোটি টাকার বিমান কেনা হবে। সেটা আমাদের লাগবে কি না, আমাদের অবকাঠামো এটার জন্য প্রস্তুত কি না, সেগুলো দেখতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র যেসব বিষয়ে উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছে, সেসব বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। যেসব বিষয়ে তারা অভিযোগ করেছে সেটারও যৌক্তিকতা আছে। তারা বলেছে যে আমাদের দেশে নানা ধরনের ব্যুরোক্রেটিক জটিলতার সম্মুখীন হয় বিনিয়োগকারীরা। সে সম্মন্ধে পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। আমি এখানে যা পেলাম তার বিপরীতে আমাকে কী কী ছাড় দিতে হবে, সেটা হিসাব করারও ব্যাপার আছে। বেসরকারি খাত কেন খরচ বহন করবে? বেসরকারি খাতও বাড়তি খরচের হিসাব করবে। আগে যদি ইউক্রেন থেকে গম আমদানিতে ৩২০ ডলার ব্যয় হতো এখন সেখানে যুক্তরাষ্ট্র থেকে গম আমদানিতে ব্যয় হবে ৩৪০ ডলার। এতে তার খরচ বেশি হবে। এখন বাড়তি খরচ বহনে বেসরকারি খাতকে সরকার কী কোনো সহায়তা দেবে, নাকি এই খরচটা ভোক্তার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হবে, সেটাই এখন দেখার বিষয়।এ ক্ষেত্রে তিনটি জিনিস গুরুত্বপূর্ণ : ১. শুল্ক লেভেল করা গেছে, এখন খরচ কমিয়ে দামে এগিয়ে যেতে হবে, ২. ব্র্যান্ড বায়ারদের সঙ্গে আলোচনায় কিছু শুল্ক ভাগ করে নেওয়ার মডেল ভাবতে হবে, ৩. যুক্তরাষ্ট্র যেসব অ-শুল্ক বাধার কথা বলেছে, যেমন মেধাস্বত্ব আইন বা ওয়ান স্টপ সার্ভিস, সেগুলো বাস্তবায়ন করলে শুধু মার্কিন বাজার নয়, সামগ্রিক বিনিয়োগ পরিবেশও উন্নত হবে।