বিশ্বজুড়ে ব্যবসায়ী নেতারা যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানির ওপর হঠাৎ শুল্ক বৃদ্ধির বাস্তবতা উপলব্ধি করতে শুরু করেছেন। বৃহস্পতিবার রাতে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এক নির্বাহী আদেশে যেসব দেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে হালনাগাদ বাণিজ্য চুক্তিতে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়েছে, তাদের জন্য নতুন শুল্ক হার ঘোষণা করেন।
সপ্তাহের শুরুতে তিনি যেসব দেশ নতুন করে সমঝোতায় পৌঁছাতে পেরেছে, তাদের জন্য একটি সংশোধিত চুক্তির কাঠামো প্রকাশ করেছিলেন।
ট্রাম্পের এই পদক্ষেপের ফলে ৯০টিরও বেশি দেশের ওপর নতুন শুল্ক কার্যকর হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক বাণিজ্য সম্পর্ক এক নতুন রূপ পেয়েছে।
মেক্সিকো
কানাডার ওপর শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৩৫ শতাংশ করলেও, উত্তর আমেরিকার আরেক গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য অংশীদার মেক্সিকো আপাতত ৯০ দিনের জন্য শুল্ক থেকে ছাড় পেয়েছে। এই সময়ের মধ্যে দেশটি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি হালনাগাদ চুক্তিতে পৌঁছাতে পারবে কি না, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
অ্যারিজোনার নাগালেসে অবস্থিত ফল ও সবজির আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান চেম্বারলেইন ডিস্ট্রিবিউটিং-এর প্রেসিডেন্ট জেইমি চেম্বারলেইন জানান, তারা প্রতিবছর মেক্সিকো থেকে লাখ লাখ বাক্স কৃষিপণ্য আমদানি করে থাকেন।
বিবিসি রেডিও ৪–এর টুডে প্রোগ্রামে তিনি বলেন, ‘আমরা আসলে খুবই সৌভাগ্যবান যে মেক্সিকো ও যুক্তরাষ্ট্রের আলোচকরা এখনো ঠান্ডা মাথায় কাজ করছেন। দুই দেশই চায় না যে এটা ভুলভাবে পরিচালিত হোক।’ ‘আর যদি সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে আরও ৯০ দিন সময় লাগে, তাহলেও সেটা আমি সার্থক মনে করি।’ তবে এখনো চুক্তি না হওয়ায়, এই অবকাশ শেষ হলে কী ঘটবে—তা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে।
চেম্বারলেইন বলেন, ‘সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতে অনেক কৃষক হয়তো রপ্তানির জন্য উৎপাদন বন্ধ করে দেবেন। আর আমদানিকারকদের পক্ষে দীর্ঘ সময় ধরে এই শুল্ক বহন করা খুব কঠিন হয়ে পড়বে।’
থাইল্যান্ড
প্রথমে ৩৬ শতাংশ শুল্ক আরোপের হুমকির মুখে থাকা থাইল্যান্ড পরে একটি চুক্তির মাধ্যমে শুল্ক কমিয়ে ১৯ শতাংশে নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়।
দেশের অন্যতম বড় কন্ট্রাক্ট ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি হানা মাইক্রোইলেকট্রনিকসের সিইও রিচার্ড হ্যান বলেন, ‘আমি এপ্রিলের সেই দিনটা মনে করতে পারি, সকালে খুব তাড়াতাড়ি উঠে দেখলাম ট্রাম্প হোয়াইট হাউসের মাঠে দাঁড়িয়ে আছেন। তখন ভাবছিলাম, ‘আমি কি ঠিক দেখেছি? ৩৬%! এটা কীভাবে সম্ভব?’
তবে তিনি মনে করেন, তার ব্যবসা যা উচ্চ প্রযুক্তির পণ্য যেমন প্রিন্টেড সার্কিট বোর্ড, ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট, মূল্য নির্ধারণের জন্য আরএফআইডি ট্যাগ তৈরি করে, নতুন কম শুল্কের চুক্তির আওতায় টিকে থাকতে পারবে।
হ্যান বলেন, ‘যদি এই অঞ্চলের সবাই প্রায় ২০% শুল্ক পায়, তাহলে আমাদের ক্রেতারা বিকল্প সরবরাহকারী খুঁজে বের করবে না—এটা হবে শুধু একটি কর, যেমন যুক্তরাষ্ট্রের ভ্যালু অ্যাডেড ট্যাক্স (ভ্যাট) মতো, যা আমেরিকান ভোক্তাদের ওপর পড়বে।’
ইতালি
ট্রাম্প প্রাথমিকভাবে দ্বিগুণ হারে শুল্ক আরোপের হুমকি দিলেও শেষ পর্যন্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে সমঝোতায় অধিকাংশ পণ্যে শুল্ক ১৫ শতাংশে স্থির হয়। তবে আগের ৪ দশমিক ৮ শতাংশ গড় শুল্কের তুলনায় এটি অনেক বেশি।
ইতালিয়ান আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের তথ্য মতে, কৃষি, ফার্মাসিউটিক্যাল ও অটোমোটিভ খাত সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হবে এবং দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন (জিডিপি) প্রায় ০.২ শতাংশ কমতে পারে।
ইতালির কৃষক সংঘের সদস্য ক্রিস্তিয়ানো ফিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এই চুক্তিটি আমার কাছে চুক্তি নয়, বরং আত্মসমর্পণের মতো মনে হচ্ছে।’
ইতালির একাধিক ব্যবসায়ী সংগঠন ইতোমধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাছে ক্ষতির জন্য ক্ষতিপূরণ দাবিতে সরব হয়েছে।
ব্রাজিল
ব্রাজিলের ওপর প্রাথমিকভাবে ১০ শতাংশ শুল্ক নির্ধারণ করা হলেও পরে তা বাড়িয়ে ৫০ শতাংশ করে ট্রাম্প প্রশাসন। ট্রাম্প ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিও লুলা দা সিলভাকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে অবিচারমূলক আক্রমণ করার অভিযোগ দেন এবং সাবেক প্রেসিডেন্ট জেইর বলসোনারোর অভ্যুত্থান চেষ্টার মামলা প্রসঙ্গে ‘উইচ হান্ট’ (ডাইনি শিকার) উল্লেখ করেন।
তবে এই উচ্চ শুল্কের কিছু ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়া হয়েছে, যেমন কমলা জুস ও বাণিজ্যিক বিমান। অন্যান্য পণ্যের দাম প্রচণ্ডভাবে বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
ব্রাজিলের কফি রপ্তানিকারক পরিষদ সিসাফে জানিয়েছে, ব্রাজিলিয়ান রোস্টার ও রপ্তানিকারকদের ওপর এর প্রভাব ‘গুরুত্বপূর্ণ’ হবে এবং আমেরিকান কফিপ্রেমীদের মূল্য বৃদ্ধির জন্য প্রস্তুত থাকতে বলেছেন। ব্রাজিলের উৎপাদক ও রপ্তানিকারকরা বিকল্প পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে।
তবে সিসাফে জানিয়েছে, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হওয়া ৮.১ মিলিয়ন টন কফির বিকল্প বাজার খুঁজে পাওয়া সহজ হবে না। এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যে নতুন বাজার তৈরি হচ্ছে, কিন্তু সেগুলো পুরো যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কজনিত চাহিদা পূরণে সক্ষম হবে না।
সুইজারল্যান্ড
১০ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপের প্রত্যাশা করলেও সুইজারল্যান্ডকে পড়তে হয়েছে ইউরোপের সর্বোচ্চ ৩৯ শতাংশ শুল্কের মুখে। দেশটির প্রেসিডেন্ট কয়েক সপ্তাহ আগেই আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন, চুক্তি সম্ভব হবে।
সুইসমেকানিক নামের একটি শিল্পপ্রতিষ্ঠান সংগঠন বলেছে, ‘এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংরক্ষণবাদী মনোভাবের স্পষ্ট ইঙ্গিত। সরকারকে এখন দৃঢ়ভাবে ও সাহসের সঙ্গে আলোচনায় যেতে হবে।’
ভারত
ভারতের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের পাশাপাশি দেশটির রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্কের কারণে অতিরিক্ত শাস্তির হুমকি দিয়েছেন ট্রাম্প। এর ফলে চা রপ্তানি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে মনে করছেন রপ্তানিকারকরা।
কলকাতার বড় চা রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান সিআই লিমিটেডের পরিচালনাকারী আওরবিন্দো নায়ক বলেন, ‘আমরা অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত হব, কিন্তু সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হবে আমেরিকান ভোক্তাদের।’
তিনি বিবিসির ওয়ার্ল্ড বিজনেস রিপোর্টে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রে চায়ের ওপর কর আরোপের ফলে শুধু মূল্যবৃদ্ধি হবে। আসামের চায়ের একটি বিশেষ স্বাদ আছে, যা আমেরিকান ভোক্তারা পছন্দ করে। দার্জিলিং চা একটি বিশেষ চা, যা অন্য কোথাও উৎপাদিত হয় না। আমেরিকায় এর চাহিদা বাড়ছে।’
লাওস
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ছোট দেশ লাওসের ওপর সবচেয়ে উঁচু শুল্ক হার — ৪০% আরোপ করা হয়েছে।
মার্কেটিং এজেন্সি এমকেজিটির সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও লাওস জাতীয় চেম্বার অব কমার্সের উপ-সভাপতি জাইবান্দিথ রাসফোন বলেন, ‘আমরা এই শুল্ক নিয়ে খুব খুশি নই… লাওস একটি খুব ছোট দেশ। লাওস শুধু কৃষিপণ্য, পোশাক, জুস ইত্যাদি আমেরিকায় রপ্তানি করে।’
বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের নিউজডে প্রোগ্রামে তিনি জানান, এই খাতে প্রায় ৬০টি কোম্পানি কাজ করছে, যেখানে প্রায় ৬০ হাজার কর্মী নিযুক্ত।
‘পরোক্ষভাবে আরও অনেক কর্মসংস্থান প্রভাবিত হতে পারে,’ তিনি যোগ করেন, এবং দেশের অর্থনীতির ওপর এর সামগ্রিক প্রভাব বড় হবে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেন।
কানাডা
কানাডার ওপর নতুন করে ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ হলেও অধিকাংশ পণ্য উত্তর আমেরিকান বাণিজ্যচুক্তির আওতায় থাকায় সে শুল্ক থেকে অব্যাহতি পাবে।
হোপ অ্যারো নামের একটি কানাডীয়ান কোম্পানির ফাইন্যান্স ভাইস প্রেসিডেন্ট ডেভিড হোপ বলেন, ‘ট্রাম্পের নতুন শুল্কের খবর পেয়ে আমি চোখ গোল করা ছাড়া কিছু করতে পারিনি।’ তার কোম্পানির বেশিরভাগ ক্লায়েন্ট যুক্তরাষ্ট্রে না থাকলেও, সরবরাহ শৃঙ্খলের জটিলতায় খরচ বাড়তে বাধ্য হবে বলে তিনি ব্যাখ্যা করেন। বহু যন্ত্রাংশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসে, এবং তিনি আশা করছেন শীঘ্রই সরবরাহকারীরা তাদের দাম বাড়িয়ে আনবেন।
তিনি বলেন, ‘আমার এক বড় সরবরাহকারীর কাছ থেকে ইতোমধ্যে শুনেছি ১০% বৃদ্ধির ব্যাপারে।’ বিমান যন্ত্রাংশের অধিকাংশই তৈরি হয় ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়াম থেকে, যেগুলোর ওপর ৫০% শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। ‘যুক্তরাষ্ট্রে ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়ামের দাম বাড়ছে, তাই সেই খরচ সরাসরি আমাদের কাছে পৌঁছবে,’ তিনি জানান।