বাংলাদেশে পর্যটন ও হসপিটালিটি খাত দ্রুত সম্প্রসারণের পথ খোলা থাকলেও দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে প্রয়োজনীয় সংখ্যক দক্ষ সংশ্লিষ্ট গ্র্যাজুয়েট তৈরি হচ্ছে না। ফলে ভয়াবহ জনবল সংকটে হুমকির মুখে পড়েছে এ খাতের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা।
বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের ‘ন্যাশনাল ট্যুরিজম হিউম্যান ক্যাপিটাল ডেভেলপমেন্ট স্ট্র্যাটেজি’ অনুযায়ী, ২০২২ সালে এই খাতে নিয়োজিত ছিল প্রায় ২৯ লাখ কর্মী। ২০৩০ সালের মধ্যে এই সংখ্যা বেড়ে ৪৩ লাখ ছাড়িয়ে যেতে পারে—অর্থাৎ চাহিদা বাড়বে ৪৫ শতাংশ।
শিল্প-খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ ব্যবস্থায় দ্রুত সংস্কার না আনলে বাংলাদেশ এ সম্ভাবনাময় খাত থেকে সুফল পাবে না।
ফলে, অনেক বিলাসবহুল হোটেল, এয়ারলাইনস এবং ট্যুর অপারেটর প্রতিষ্ঠান তাদের শীর্ষ ব্যবস্থাপনা পদগুলোতে বিদেশি পেশাজীবীদেরই নিয়োগ দিচ্ছে।
গুলশানের একটি ফাইভ-স্টার হোটেলের মহাব্যবস্থাপক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, “লিডারশিপ, ফাইন্যান্স এবং রন্ধনশিল্প সংশ্লিষ্ট পদগুলোতে দক্ষ জনশক্তির ঘাটতি ভয়াবহ।”
তিনি বলেন, “আমাদের ইন্টার্ন এবং এন্ট্রি-লেভেল কর্মীরা পিছিয়ে পড়ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর পাঠ্যক্রমে রেভিনিউ ম্যানেজমেন্ট, কস্ট কন্ট্রোল কিংবা ডিজিটাল হসপিটালিটি মার্কেটিংয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর ওপর প্রশিক্ষণই দেওয়া হয় না।”
তার ভাষ্য, হোটেল মালিক এবং আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডগুলো এখনও লিডারশিপের ক্ষেত্রে বাংলাদেশিদের প্রতি পুরোপুরি আস্থা রাখতে পারছে না।
বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের গবেষণায়ও পর্যটন খাতের গুরুতর দুর্বলতাগুলো উঠে এসেছে। এ খাতের প্রায় ২৭ শতাংশ কর্মীর মৌলিক যোগাযোগ দক্ষতা নেই। রেস্তোরাঁ খাতে ২২ শতাংশ কর্মী কাস্টমার সার্ভিসে দুর্বল। আবার ট্যুর অপারেটরদের ২৭ শতাংশ কোনো বিদেশি ভাষায় কথা বলতে পারেন না—যা আন্তর্জাতিক পর্যটকদের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
জার্নি প্লাসের সিইও তৌফিক রহমান বলেন, “অনেক উদ্যোক্তা এই খাতে এসেছেন, কিন্তু প্রয়োজনীয় দক্ষ জনবল পাচ্ছেন না। অপারেশনাল স্তরে—বিশেষ করে সেলস, মার্কেটিং, আইটিনারারি পরিকল্পনা ও ক্লায়েন্ট কমিউনিকেশনে স্পষ্ট ঘাটতি রয়েছে। বিদেশি ভাষা জানে, এমন ট্যুর গাইড পাওয়া সবচেয়ে কঠিন।”
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০৩০ সালের মধ্যে শুধু আবাসন খাতে প্রয়োজন হবে ৪ লাখ ৭ হাজার কর্মী। এছাড়া রেস্তোরাঁ, ক্যাফে ও ফাস্টফুড প্রতিষ্ঠানে প্রয়োজন হবে ২৪ লাখ, বিনোদন খাতে ২ লাখ ৬৩ হাজার, ট্যুর অপারেটর ও ট্রাভেল এজেন্সিতে ৯০ হাজার ২৮০, ট্যুরিস্ট ভেসেলস খাতে ১৫ হাজার ৩৪২, বাস ও কোচ সার্ভিসে ২৫ হাজার ৯৯ এবং এয়ারলাইন্সে ৩৪ হাজার ৪২২ জন।
আমিউজমেন্ট পার্ক খাতে বছরে ইতোমধ্যেই ৬ কোটির বেশি টিকিট বিক্রি হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০৩০ সালের মধ্যে এই খাতে আরও ১ লাখ নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হতে পারে। কিন্তু প্রশিক্ষিত কর্মী না থাকলে, সেই শূন্যতা আবারও বিদেশিরা এসে পূরণ করবে—এমন আশঙ্কাও প্রকাশ করছেন তারা।
পিছিয়ে রয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো
বর্তমানে দেশের বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতি বছর প্রায় ৩৫ হাজার গ্র্যাজুয়েট তৈরি করছে। অথচ এই খাতে প্রতি বছর ১.৫ থেকে ২ লাখ দক্ষ জনবলের চাহিদা রয়েছে।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ার হোসেন ভূঁইয়া বলেন, “সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের পাঠ্যক্রম বা সিলেবাস খুব কমই হালনাগাদ করে। প্র্যাকটিক্যাল ট্রেনিংও সীমিত। ফলে গ্র্যাজুয়েটরা বাজারের চাহিদার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারে না।”
তিনি বলেন, বেতন কম হওয়াটাও একটি বড় কারণ। “ব্যাংক কিংবা সরকারি চাকরিতে একজন গ্র্যাজুয়েট ৩০–৪০ হাজার টাকা বেতন পায়। কিন্তু পর্যটন খাতে তাদের ১৫–২০ হাজার টাকা দিয়েই শুরু করতে হয়। ফলে আগ্রহ কমে যায়।”
তিনি আরও বলেন, ইংরেজির পাশাপাশি আরবি, ম্যান্ডারিনসহ অন্যান্য ভাষার দক্ষতাও খুবই জরুরি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক একজন শিক্ষার্থী জানান, পর্যটন খাতে বেতন কম হওয়ায় তিনি সরকারি ব্যাংকে চাকরি নিয়েছেন।
বর্তমানে দেশে ২৫টি বিশ্ববিদ্যালয় এবং ১১টি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত কলেজসহগ মোট ৫২টি প্রতিষ্ঠান পর্যটন বিষয়ে পড়াশোনার সুযোগ দিচ্ছে। তবে ডিপ্লোমা ভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা থেকেই কর্মক্ষেত্রের জন্য উপযোগী গ্র্যাজুয়েট তৈরি হচ্ছে বেশি। প্রতিবছর প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে প্রায় ৮ হাজার ডিপ্লোমাধারী বের হলেও, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখনও তাত্ত্বিক শিক্ষার ওপরেও বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে।
জার্নি প্লাসের সিইও তৌফিক রহমান বলেন, “দুর্ভাগ্যজনকভাবে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা ৮০ শতাংশ শিক্ষার্থীই এই খাতে থাকছে না। আমাদের প্রকৃতপক্ষে বর্তমানে যে জনবল আছে, তার তিনগুণ দরকার। কিন্তু দক্ষতার অভাবে অনেকে খাত ছেড়ে চলে যাচ্ছে।”
গ্র্যাজুয়েটদের প্রত্যাশা ও বাস্তবতার মাঝে দূরত্ব
বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের সিইও আবু তাহের মোহাম্মদ জাবের বলেন, গ্র্যাজুয়েটদের প্রত্যাশা আর বাস্তবতার মাঝে বিশাল ব্যবধান রয়েছে।
তিনি বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এমন গ্র্যাজুয়েট তৈরি করছে, যারা শুরু থেকেই ম্যানেজমেন্ট লেভেলের চাকরি চান। কিন্তু হোটেলগুলো যখন তাদের হাউসকিপিং কিংবা ফ্রন্ট ডেস্কে শুরু করতে বলে, তখন তারা সেটি মেনে নিতে পারেন না।”
অন্যদিকে, চার মাসের তাত্ত্বিক ও দুই মাসের ব্যবহারিক প্রশিক্ষণ নেওয়া ডিপ্লোমাধারীরা সাধারণত প্রাথমিক পর্যায়ের চাকরিতে ভালো পারফরম্যান্স করে থাকেন।
ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ইন্ডাস্ট্রি স্কিলস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান মোহিউদ্দিন হেলাল বলেন, যোগানের তুলনায় চাহিদা অনেক বেশি।
“আরও ভালো মানের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান প্রয়োজন। গ্র্যাজুয়েটদের সঙ্গে শিল্পখাতের সংযোগ তৈরি করাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ—আমরা সেটা নিয়েই কাজ করছি। আগামী তিন বছরে আমরা প্রায় ৭ হাজার কর্মীকে দক্ষ করে তুলতে চাই, যাদের কেউ স্থানীয় পর্যায়ে, আবার কেউ বিদেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ পাবেন,” যোগ করেন তিনি।