দেশে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য আরো কমিয়ে এনেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। নতুন মুদ্রানীতিতে এ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে মাত্র ৭ দশমিক ২ শতাংশ। একই সঙ্গে মূল্যস্ফীতির হার ৭ শতাংশে নেমে না আসা পর্যন্ত নীতি সুদহার বা রেপো রেট ১০ শতাংশে অপরিবর্তিত রাখার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথমার্ধের মুদ্রানীতিতে এসব ঘোষণা দেয়া হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর গতকাল চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধের জন্য মুদ্রানীতি ঘোষণা করেন। এ উপলক্ষে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জাহাঙ্গীর আলম সম্মেলন কক্ষে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। ডেপুটি গভর্নর, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উপদেষ্টা, বিএফআইইউ প্রধান, দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক, মুখপাত্রসহ সংশ্লিষ্টরা উপস্থিত ছিলেন। নতুন মুদ্রানীতির লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে মুদ্রাস্ফীতির হার আরো কমানো, বিনিময় হার ও আর্থিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা।
এ বিষয়ে গভর্নর বলেন, ‘চলতি বছরের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে ১০ শতাংশ নীতি সুদহার বহাল থাকবে। যতদিন না মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশের নিচে নামবে, ততদিন এ সুদহার অপরিবর্তিত থাকবে। একই সঙ্গে স্ট্যান্ডিং লেন্ডিং ফ্যাসিলিটির (এসএলএফ) হার ১১ শতাংশ এবং স্ট্যান্ডিং ডিপোজিট ফ্যাসিলিটির (এসডিএফ) হার ৮ শতাংশে অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে।’
সাম্প্রতিক সময়ে মূল্যস্ফীতির হার কিছুটা কমলেও এখনো তা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি বলে উল্লেখ করেন গভর্নর। তিনি বলেন, ‘টাকার অবমূল্যায়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক ব্যবস্থার কারণে আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ায় মূল্যস্ফীতির ওপর নতুন চাপ তৈরি হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে আগামী ছয় মাসের জন্য কঠোর মুদ্রানীতি অব্যাহত রাখা হবে।’
সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির অংশ হিসেবে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হয়েছিল ৯ দশমিক ৮ শতাংশ। কিন্তু বিনিয়োগ স্থবিরতায় এক অংকের এ লক্ষ্যও অর্জিত হয়নি। অর্থবছর শেষে এ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে মাত্র ৬ দশমিক ৪০ শতাংশ। নিকট অতীতে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধিতে এতটা ভাটা দেখা যায়নি। এ পরিস্থিতিতে আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত এ খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ৭ দশমিক ২ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে আর ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৮ শতাংশ।
একদিকে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা কমেছে, অন্যদিকে নীতি সুদহার ১০ শতাংশেই অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। উচ্চ সুদহারের কারণেই বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা কমেছে কিনা এমন প্রশ্নে গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘আমরা কৃত্রিম কোনো লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করতে চাই না। কেউ যদি পরিস্থিতির উন্নয়ন করে আরো বেশি ঋণ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারে, আমরা তাদের আটকে রাখব না। বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধিকে আমরা সীমিত করছি না। তবে শুধু মূল্যস্ফীতি কমলেই সুদহার কমানো হবে, এর আগে নয়। আমাদের মূল উদ্দেশ্য দুটি—মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও ব্যাংকিং খাতের স্থিতিশীলতা। আমরা এ দুই লক্ষ্য নিয়েই কাজ করে যাচ্ছি।’
দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমলেও চালের দাম ঊর্ধ্বমুখী। এ বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে গভর্নর বলেন, ‘ভরা মৌসুমে রেকর্ড উৎপাদন হওয়ার পরও চালের দাম বাড়ার একটা কারণ হতে পারে কৃষকরা নিজেদের চাল ধরে রেখেছেন। এখানে মধ্যস্বত্বভোগীরা যে খুব উপকারী হচ্ছে তা নয়। চালের বাজারে লাগাম টেনে ধরতে ইতিমধ্যে সরকার চার লাখ টন চাল আমদানির ঘোষণা দিয়েছে। বিশ্ববাজারে চালের দাম ঊর্ধ্বমুখী নয়। দরকার হলে আমরা আরো বেশি চাল আমদানি করব। সে অর্থ জোগান করতে পারব আমরা। আশা করি শিগগিরই চালের দাম নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে।’
রুগ্ণ ব্যাংকগুলো একীভূতকরণের সিদ্ধান্ত সামনে আসার পর অনেক আমানতকারীই উদ্বিগ্ন হয়ে সেসব ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিয়ে যাচ্ছেন। এ বিষয়ে আমানতকারীদের চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই বলে দাবি করেন গভর্নর। তিনি বলেন, ‘আমানতকারীদের টাকা সম্পূর্ণ নিরাপদ। তারা প্রত্যেকেই তাদের টাকা ফেরত পাবেন। একটা সার্জিক্যাল অপারেশনের মাধ্যমে ব্যাংকের মূলধন ভিত্তিকে মজবুত ও সুশাসন নিশ্চিত করা হবে। একীভূতকরণের মাধ্যমে ব্যাংকগুলো শুধু ঘুরেই দাঁড়াবে না, বরং যে বিনিয়োগ করা হবে, সেটা লভ্যাংশসহ পুরোপুরি ফেরত পাবে সরকার।’
গভর্নর বলেন, ‘আমরা যদি সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা আনতে না পারি, তাহলে আমাদেরকে প্রবৃদ্ধির কথা ভুলে যেতে হবে। আমাদের প্রবৃদ্ধি হতে হবে টেকসই। সেজন্য আমাদের ব্যালান্স অব পেমেন্ট (বিওপি) স্বস্তিদায়ক অবস্থায় থাকতে হবে। ইতিমধ্যে ডলারের দামে স্থিতিশীলতা ফিরে এসেছে। মূল্যস্ফীতিও কমে আসছে। এখন জিডিপির যে ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হচ্ছে, এটা যথেষ্ট। এর মধ্যে কোনো ভেজাল নেই। আগামী বছর সাড়ে ৫ থেকে ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে। আমাদেরকে শুধুমাত্র বিনিয়োগের দিকে তাকিয়ে থাকলে হবে না। সংকটকালীন সময়ে টিকে থাকার মানসিকতা দরকার। রাজনৈতিক পরিবেশ ঠিকঠাক থাকলে নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে হয়তো আমরা বিনিয়োগের ভিন্ন চিত্র দেখব।’