বাংলাদেশে মৌসুমি বায়ু আসার আগে কালবৈশাখী আভাস দেখা যায় । সাধারণত মার্চের শেষ থেকে শুরু করে মে মাস পর্যন্ত এই ঝড় হয়ে থাকে। সম্প্রতি দেখা দিয়েছে জলবাযুর প্রভাবে কালবৈশাখী ঝড়ের আভাস।
বিশেষ করে কালবৈশাখীর সময় বজ্রপাতের সম্ভাবনা দেখা দেয়। বাংলাদেশে বজ্রপাতের মূল কারণ হচ্ছে ভৌগোলিক অবস্থান ও বায়ুদূষণ। একদিকে বঙ্গোপসাগর, অন্যদিকে ভারত মহাসাগর।
উত্তরে রয়েছে পাহাড়ি অঞ্চল। সাধারণত বর্ষাকাল আসার আগে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়। এ সময় বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বেড়ে যায়। সাগর থেকে আসে গরম বাতাস, আর হিমালয় থেকে আসে ঠান্ডা বাতাস।একসাথে দুই ধরণের বাতাসের সংমিশ্রণে বজ্রপাতের উৎপত্তি ঘটে।
বছরের এই সময়টাতে দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় বেশিভাগ ক্ষেত্রে মানুষের মৃত্যু ঘটে। তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় বজ্রপাতের আশঙ্কা ৮ শতাংশ বৃদ্ধি পায়।
বর্তমানে বাতাসে সিসার পরিমাণ বৃদ্ধি, অধিক ধাতব পদার্থের ব্যবহার, মোবাইল ফোন ব্যবহারের আধিক্য এবং টাওয়ারের সংখ্যা বৃদ্ধি, বনভূমি ও উঁচু গাছের সংখ্যা কমে যাওয়া, জলাভূমি ভরাট ও নদী শুকিয়ে যাওয়ার কারণে বজ্রপাতের আশঙ্কা বাড়ছে।
দেশে বজ্রপাতের সময় মৃত্যুর ৯৮ শতাংশই কারণই বাইরে খোলা আকাশের নিচে থাকা।
আবহাওয়াবিদরা বলেছেন, প্রকৃতিতে এখন চলছে কালবৈশাখীর প্রাক-প্রস্তুতি পর্ব। আবহাওয়ার স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী, ধীরে ধীরে বাড়তে থাকবে তাপমাত্রা।
শীতের বিদায়ের পর ফাল্গুন, চৈত্র, বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ মাসে বাংলাদেশ,পশ্চিমবঙ্গ ও সমগ্র পূর্ব থেকে উত্তরপূর্ব ভারতে যে ঝড় বয়ে যায়, তাই কালবৈশাখী।
বাংলা বছরের শুরুতে বৈশাখ মাসে এই ঝড় তুলনামূলকভাবে বেশি হয় বলেই এটি কালবৈশাখী নামে পরিচিত। চৈত্র মাসের শুরুতেই ভারতের উপকূলে মৌসুমের প্রথম কালবৈশাখী আঘাত হানতে পারে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাসে বলা হয়েছে ,দেশের উত্তর, উত্তর-পশ্চিম ও মধ্যাঞ্চলে একাধিক মাঝারি বা তীব্র কালবৈশাখী ঝড় হতে পারে। দেশের অন্যান্য অঞ্চলে দুই-তিন দিন বজ্র ও শিলাবৃষ্টিসহ হালকা বা মাঝারি ধরনের কালবৈশাখী হতে পারে।
আবার অনেকে বলছেন, এবার সারাদেশে আমের ফুল বেশি দেখা যাচ্ছে। তাই অনেকে আশঙ্কা করছেন, এবার বেশিমাত্রায় কালবৈশাখী ঝড় হতে পারে।
আবহাওয়াবিদের মতে , বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে বেশি বেশি প্রাকৃতিক দুর্যোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। সাধারণ ঝড় গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালে হয় গভীর সমুদ্রে নিম্নচাপসহ নানা কারণে। এসব ঝড়ের সময় বিদ্যুৎ নাও চমকাতে পারে বা বজ্রপাত নাও হতে পারে।
কিন্তু কালবৈশাখী ঝড়ের সঙ্গে বিদ্যুৎ চমকায় এবং বজ্রপাত হয়। এ ধরনের ঝড়ে সাইক্লোন বা টর্নেডোর মতো ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি না হলেও যে এলাকায় হয় , সেখানে গাছপালা এবং মানুষের বড় ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে।
বাংলাদেশে প্রায় প্রতিবছরই কালবৈশাখী হয়। এর স্থায়িত্বকাল হয় অল্প। একটি কালবৈশাখী ঝড় তৈরি হয়ে পূর্ণতা লাভের পর ৩০-৪৫ মিনিট পর্যন্ত এর তীব্রতা থাকে। পরে তা ধীরে ধীরে কমতে থাকে। বাংলাদেশের পশ্চিমাঞ্চলে সাধারণত শেষ বিকালে এবং সন্ধ্যার দিকে কালবৈশাখী হয়।
বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর, ভারতীয় আবহাওয়া অফিস ও জাপানের মহাকাশ গবেষণা সংস্থার তথ্য বলেছেন, বন্যা,খরা,কালবৈশাখী ও ঘূর্ণিঝড় বাংলাদেশের নিত্যসঙ্গী। এর মধ্যে নতুন দুর্যোগ বজ্রপাত ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে।
বজ্রপাতে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি মানুষের মৃত্যু হচ্ছে বাংলাদেশে। আবহাওয়াবিদরা বলেছেন, বজ্রপাতের ডেড জোন এখন বাংলাদেশ।
বাংলাদেশে বর্ষা আসার আগে থেকে তাপমাত্রা বাড়তে থাকে। এতে বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। আর দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর থেকে ভেসে আসা আর্দ্র বায়ু আর উত্তরে হিমালয় থেকে আসা শুষ্ক বায়ুর মিলনে কালবৈশাখী বয়ে যায় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। ঝড়ের সময় বেশি বজ্রপাত ঘটে।
বজ্রপাতে মৃত্যুর ৯৩ শতাংশই ঘটে গ্রামাঞ্চলে। এর মধ্যে ৮৬ শতাংশের হয় মৃত্যু উন্মুক্ত স্থানে। এ ছাড়া বাড়ি ফেরার পথে ৬ শতাংশ এবং গোসল করা ও মাছ ধরার সময় ৮ শতাংশ মৃত্যুর ঘটনা ঘটে।
গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশে বছরে প্রায় এক হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে বজ্রপাতের কারণে। বজ্রপাতে মৃত্যুর চেয়ে দশগুণ বেশি মানুষ আহত হয়েছেন। বজ্রপাতকে আবহাওয়া সম্পর্কিত দ্বিতীয় বৃহত্তম ঘাতক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
জাপানের মহাকাশ গবেষণা সংস্থার তথ্য মতে, বাংলাদেশে গড়ে বছরে আড়াই হাজার বজ্রপাতের ঘটনা ঘটে। বাংলাদেশে বেশি মৃত্যুর জন্য সচেতনতার অভাবকেই দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। সচেতনতাই পারে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাতে।
বজ্র্রপাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের কিছু দিকনির্দেশনা রয়েছে।এতে বলা হয়েছে, “বজ্রপাত সাধারণত ৩০-৪৫ মিনিট স্থায়ী হয়। এ সময় ঘরে বা বাসাবাড়িতে অবস্থান করতে। রাবারের জুতা পড়া, বজ্রপাতের সময় খোলা জায়গা, মাঠ অথবা উঁচু স্থানে না থাকা। এ সময় ধান ক্ষতে বা খোলা মাঠে থাকলে তাড়াতাড়ি পায়ের আঙ্গুলের ওপর ভর দিয়ে এবং কানে আঙ্গুল দিয়ে মাথা নিচু করে বসে থাকা।
বজ্রপাতের আশঙ্কা দেখা দিলে যত দ্রুত গাছপালা ও বৈদ্যুতিক খুঁটি ও তার বা ধাতব খুঁটি, মোবাইল টাওয়ার ইত্যাদি থেকে দূরে থাকা। আকাশে কালো মেঘ দেখা দিলে নদী, পুকুর ডোবা বা জলাশয় থেকে দূরে থাকতে হবে। বজ্রপাতের সময় গাড়ির ভেতর অবস্থান করলে, গাড়ির ধাতব অংশের সঙ্গে শরীরের সংযোগ ঘটাবেন না, সম্ভব হলে গাড়িটি নিয়ে কোনো কংক্রিটের ছাউনির নিচে আশ্রয় নিতে হবে।
বজ্রপাতের সময় বাড়িতে থাকলে জানালার কাছাকাছি ও বারান্দায় থাকা যাবে না। জানালা বন্ধ রাখুন এবং ঘরের ভেতর বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম থেকে দূরে থাকতে হবে। বজ্রপাতের সময় ধাতব হাতলযুক্ত ছাতা ব্যবহার করা যাবে না। এ সময় শিশুদের খোলা মাঠে খেলাধুলা থেকে বিরত রাখুন এবং নিজেরাও বিরত থাকুন।
বজ্রপাতের সময় ছাউনবিহীন নৌকায় মাছ ধরতে যাওয়া যাবে না, তবে এ সময় সমুদ্র বা নদীতে থাকলে নৌকার ছাউনির নিচে অবস্থান করতে হবে। বজ্রপাত ও ঝড়ের সময় বাড়ির ধাতব কল, সিঁড়ির রেলিং পাইপ ইত্যাদি স্পর্শ করবেন না। খোলা স্থানে অনেকে একত্রে থাকাকালীন বজ্রপাত শুরু হলে প্রত্যেকে ৫০-১০০ ফুট দূরে সরে যাওয়া। কোনো বাড়িতে যদি পর্যাপ্ত নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা না থাকে তাহলে সবাই এক কক্ষে না থেকে আলাদা আলাদা কক্ষে থাকা ভালো।
ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় হাঁটার দূরত্ব বেঁধে ইটের অস্থায়ী ঘর তৈরি করতে হবে। যেখানে কৃষক ও মাঠে কাজ করা মানুষ কিছু সময় সুরক্ষার জন্য দাঁড়াতে পারেন। মাঠে যারা কাজ করেন, তারা যদি ওই সময়টা পাকা ঘরে আশ্রয় নিতে পারেন, তাহলে মৃত্যুহার কমানো সম্ভব হবে।
দৈনিক অর্থনীতি