২০২০ সালের শুরু থেকে ব্যাংকঋণ পরিশোধে বিশেষ ছাড় পেয়ে আসছেন ঋণগ্রহীতারা। বছরজুড়ে ঋণের কোনো কিস্তি পরিশোধ না করেই খেলাপি হওয়া থেকে তারা নিষ্কৃতি পেয়েছিলেন।
ব্যাংকঋণের কিস্তি পরিশোধে গ্রাহকদের আবারো বিশেষ ছাড় দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আগে ডিসেম্বর পর্যন্ত কিস্তির ৭৫ শতাংশ অর্থ জমা দিলেই আর খেলাপি হতেন না ব্যবসায়ীরা।
এখন অর্ধেক অর্থাৎ কিস্তির ৫০ শতাংশ জমা দিলেই খেলাপি হওয়ার হাত থেকে নিষ্কৃতি মিলবে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত অক্টোবর থেকে চলতি ডিসেম্বরের মধ্যে যাদের কিস্তি দেয়ার কথা রয়েছে কেবল তারাই এ সুযোগ পাবেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে গতকাল জারি করা এক প্রজ্ঞাপনে নতুন এ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
কোভিড-১৯ সৃষ্ট আর্থিক দুর্যোগের কারণে ইতিহাসে প্রথমবার বিশেষ এ ছাড় দেয়া হয়েছিল। ২০২১ সালজুড়েও ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন ধরনের নীতিছাড় ভোগ করেছেন। এখন কোভিড না থাকলেও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কথা বলে ঋণ পরিশোধে নতুন ছাড় দেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, বহির্বিশ্বে যুদ্ধাবস্থা প্রলম্বিত হওয়ায় তার দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাবে শিল্পের উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে। এতে কমে গিয়েছে ঋণগ্রহীতাদের প্রকৃত আয়। দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড গতিশীল রাখা এবং ঋণগ্রহীতাদের কিস্তি পরিশোধ সহজ করতেই মেয়াদি ঋণের বিপরীতে গত অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত কিস্তির ন্যূনতম ৭৫ শতাংশের পরিবর্তে ৫০ শতাংশ পরিশোধ করলেই সে ঋণগুলো খেলাপি করা যাবে না।
এ সময়ে কিস্তির যেসব টাকা বকেয়া থাকবে তা ঋণের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরবর্তী এক বছরের মধ্যে পরিশোধ করতে হবে। এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, চলতি বছরের এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রদেয় কিস্তির অপরিশোধিত অংশ বিদ্যমান ঋণের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরবর্তী এক বছরের মধ্যে সমকিস্তিতে পরিশোধ করতে হবে। তবে ব্যাংকার-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে অবশিষ্ট মেয়াদের সঙ্গে বর্ধিত এক বছর সময়কে বিবেচনায় নিয়ে কিস্তি পুনর্নির্ধারণপূর্বক নতুন সূচি অনুযায়ী আদায় করা যাবে।
ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সভাপতি মো. জসিম উদ্দিনের নেতৃত্বে ব্যবসায়ী নেতারা গত সপ্তাহে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের সঙ্গে বৈঠক করেন। ওই বৈঠকে ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে বিভিন্ন দাবি তুলে ধরা হয়। এর মধ্যে একটি ছিল ব্যাংকঋণের কিস্তি পরিশোধে আবারো নীতিছাড় দেয়া।
গভর্নরের সঙ্গে বৈঠক শেষে ওইদিন এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বলেছিলেন, ‘গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটের কারণে দেশের শিল্প-কারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। এখনো গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকট কাটেনি। শিল্পোৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় রফতানি খাতও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে কারখানায় কর্মরত শ্রমিকদের বেতন পরিশোধ করাই কঠিন হচ্ছে। এ অবস্থায় ডিসেম্বরের ঋণের কিস্তি ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানোর অনুরোধ করেছি। ৩০ জুন পর্যন্ত যেন ব্যবসায়ীদের ঋণ খেলাপি করা না হয়, সে দাবি জানিয়েছি।’
ব্যবসায়ী নেতাদের ওই দাবির পরিপ্রেক্ষিতেই ঋণ পরিশোধে নতুন ছাড় দেয়া হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। তবে বারবার ঋণ পরিশোধে ছাড় দেয়ার ঘটনায় ব্যাংকের আর্থিক ভিত দুর্বল হচ্ছে বলে মনে করছেন ব্যাংক নির্বাহীরা। দেশের অন্তত দুটি ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বণিক বার্তাকে বলেন, গ্রাহকদের কাছ থেকে সংগৃহীত আমানত থেকেই ঋণ বিতরণ করা হয়। আমানতের মেয়াদ যেমন নির্দিষ্ট, তেমনি ঋণের মেয়াদও নির্ধারিত।
এখন বারবার ঋণ পরিশোধের সময় বাড়ানোর কারণে ব্যাংকগুলোর তহবিল ব্যবস্থাপনা নাজুক পরিস্থিতিতে পড়েছে। অনেক ব্যাংক নিজেদের তহবিল ঠিক রাখতে হিমশিম খাচ্ছে। দেশের ব্যাংক খাতে এখন তারল্য সংকটও চলছে। নতুন নির্দেশনার ফলে তারল্য সংকট আরো বাড়বে। আবার দীর্ঘমেয়াদে ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের ঝুঁকিও বেড়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩৪ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা। ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ঋণের ৯ দশমিক ৩৬ শতাংশই বর্তমানে খেলাপি। ঋণ পরিশোধে বিশেষ ছাড়ের কারণে ডিসেম্বর পর্যন্ত খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির হার কিছুটা অব শ্য কমে আসবে।